উচ্চ রক্তচাপের কারণ ও প্রতিকার

স্বাস্থ্য ডেস্ক রিপোর্ট: উচ্চ রক্তচাপকে এক ধরনের নীরব ঘাতক বলা হয়ে থাকে, কারণ খুব সহজে এর উপসর্গ বোঝা যায় না, কিন্তু নীরবে হৃৎপিণ্ডের ক্ষতিসাধন করে থাকে।

ইংল্যান্ডের প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন কিন্তু অনেকেই প্রথমে তাদের এই রোগটা ধরতে পারেন না।

কিন্তু যখন বুঝতে পারেন তখন হার্ট-অ্যাটার্ক, স্ট্রোক, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

উচ্চ রক্তচাপ
হৃৎপিণ্ড রক্ত সঞ্চালন করার সময় শিরা ও ধমনীর ওপরে যে পরিমাণ চাপ দিয়ে থাকে তাই হচ্ছে রক্তচাপ। কিন্তু যখন বিভিন্ন কারণে হৃৎপিণ্ডের রক্ত নালী সরু হয়ে শক্ত হয় এবং হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে যায় তখন রক্ত চলাচল করতে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় শক্তির বা চাপের প্রয়োজন হয়, এটাই হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ।

হৃৎপিণ্ড এভাবে চাপ প্রয়োগ করে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত ছড়িয়ে দেয়। এই রক্ত চাপের মাধ্যমে বোঝা যায় হৃৎপিণ্ড কি পরিমাণ রক্ত সরবরাহ করছে অথবা রক্ত নালী রক্ত প্রবাহে কি পরিমাণ বাধা প্রধান করছে। রক্ত নালীর সরু বা প্রশস্তের ওপর রক্ত প্রবাহ নির্ভর করে। রক্ত নালী সরু হলে রক্ত চাপ বাড়বে কিন্তু রক্তের প্রবাহ কমবে এবং রক্ত নালী প্রসস্থ হলে রক্ত প্রবাহ বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে রক্ত চাপ কমবে।

রক্তচাপ পরিমাপ

দিনের বিভিন্ন সময় রক্তচাপ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সাধারণত ব্যায়াম, হাঁটা-চলার সময় রক্তচাপ বেশি থাকে এবং ঘুমানোর সময় রক্তচাপ কম থাকে। এমনকি মানুসিক চাপেও রক্তচাপ বাড়তে পারে। তাই বিভিন্ন সময়ে রক্তচাপ পরিমাপ করে তার গড় করলে রক্তচাপের সঠিক অবস্থা জানা যায়।

দুই অবস্থায় রক্তচাপ পরিমাপ

সংকোচনশীল (সিস্টোলিক-Systolic) অবস্থায়: হৃৎপিণ্ডের সংকোচনের মাধ্যমে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত হৃৎপিণ্ড হতে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। এ সংকোচনের সময় চাপের পরিমাপ তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য সাধারণত ১২০ মিলিমিটার মার্কারি (mmHg), তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপের মাত্রা বাড়তে থাকে।

প্রসারণশীল (ডায়াস্টলিক-Diastolic) অবস্থায়: এ অবস্থায় কার্বনডাইঅক্সাইড যুক্ত রক্ত শরীর থেকে হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে। এসময় এর চাপ প্রাপ্ত বয়স্কদের সাধারণত ৮০ মিলিমিটার মার্কারি (mmHg), এর মাত্রাও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে পারে।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ

সাধারণ দুই ধরনের রক্তচাপে ভুগেন মানুষ। এগুলো হচ্ছে- প্রাইমারি উচ্চ রক্তচাপ ও সেকেন্ডারি উচ্চ রক্তচাপ।

প্রাইমারি উচ্চ রক্তচাপ: সাধারণত উচ্চরক্ত চাপের ৯০ ভাগ কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়না। তাই যে রক্তচাপের কোনো কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হয়না তা হচ্ছে প্রাইমারি উচ্চ রক্তচাপ। এ ধরনের উচ্চ রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের জন্য খুব বিপজ্জনক এবং নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে। কারণ এ ধরনের রক্তচাপ প্রতিরোধ না হলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জটিল হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

সেকেন্ডারি উচ্চ রক্তচাপ: চর্বি বা রক্ত জমাট বেধে রক্তনালী সরু হলে আড্রেনাল গ্রন্থে ফোরা বা টিউমার হলে, কিডনির সমস্যা হলে, কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে যেমন ব্যাথানাশক ওষুধ (ইবুপ্রফেন, নাপ্রক্সেন) সেবন করলে বাকি ১০ ভাগ উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। এটি নিরাময় যোগ্য, চিকিৎসা নিলে সেকেন্ডারি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

এছাড়াও আরও কারণ রয়েছে উচ্চ রক্তচাপের পেছনে। এগুলো হচ্ছে-

  • অতিরিক্ত ওজন
  • পরিবারের কারো উচ্চ রক্তচাপ থাকলে
  • অতিরিক্ত মাত্রায় লবণ খেলে
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি না খেলে
  • নিয়মিত হাঁটা-চলা বা ব্যায়াম না করলে
  • অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (যেমন- চা, কপি) পান করলে
  • অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যালকোহল পান করলে
  • বয়স ৬৫ বছরের বেশি হলে

প্রতিকার ও চিকিৎসা
ওপরের উল্লেখিত কোনো লক্ষণ আপনার দেখা দিলে সর্বপ্রথম আপনার জীবন ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য আপনাকে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে-

  • ওজন বেশি হলে ওজন কমাতে হবে
  • নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটতে হবে
  • পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে
  • ধূমপান পরিহার করতে হবে
  • অ্যালকোহলের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করতে হবে
  • খাবারে লবণের মাত্রা কমাতে হবে এবং চা, কফির অভ্যাস পরিহার করতে হবে।

উচ্চ রক্ষচাপ নিয়ন্ত্রণে রিভার্সাল ডায়েট

(হৃদরোগ/উচ্চ রক্তচাপ/ফ্যাটি লিভার/ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্য এটি পরীক্ষিত পদ্ধতি)

✅ ঘুম থেকে উঠেই (সূর্যোদয়ের পূর্বে) খালি পেটে অন্তত দুই গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করুন। আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে, সূর্যোদয়ের পুর্বে খালি পেটে জলপান করাকে ঊষাপান বলে। এইরূপ জলপান অভ্যাস করলে বাত-পিত্ত-কফজনিত যাবতীয় পীড়া, বিশেষত: অর্শ, শোথ, গ্রহণী, জীর্ণজ্বর, উদর কুষ্ঠ, মেদোরোগ, মুত্রাঘাত, কর্ণরোগ, শিরোরোগ, চক্ষুরোগ, কটিশূল এবং জরা নিবারিত হয়। এতে শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে যায়। ঠাণ্ডা জলের পরিবর্তে হালকা গরম জল পানে শরীরের আর্দ্রতা বজায় থাকে।

✅ ঊষাপানের ১০-১৫ মিনিট পরে আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা বাদাম, বীজ, ছোলা, আদা, খেঁজুর প্রভৃতি খেয়ে নিন। পরিমাণ-
বাদাম: চীনা বাদাম- ৫টি, কাঠ বাদাম- ৫টি, পেস্তা বাদাম- ৫টি, কাজু বাদাম- ২টি, আখরোট- ১টি; বীজ- মিষ্টি কুমড়ার বীজ- ১০টি, সূর্যমুখীর বীজ- ১০টি; ছোলা- ২০টি; আদা- ১ টুকরো, খেঁজুর- ১টি।

✅ ভোর ৬:০০-৭:০০ টা পর্যন্ত শারীরিক পরিশ্রম/ব্যায়াম ও ইয়োগা করুন।

✅ সকাল ৮:০০ টা : মিক্সড সবজি (অর্ধসেদ্ধ), শাক, ভর্তা দিয়ে ২-৩টি লাল আটার রুটি অথবা, পরিমিত লাল চালের ভাত/খিচুড়ি। রুটি বা ভাত খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিটের মধ্যে পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন।

✅ বেলা ১১:০০ টা : অন্তত দুই ধরনের সাইট্রাস ফল যেমন লেবু, মোসাম্বি লেবু, কমলা লেবু, আঙুর, মালটা, জাম্বুরা প্রভৃতি খান।

✅ দুপুর ১২:০০-০১:০০ টা : এক গ্লাস গ্রীন জুস তৈরি করে পান করুন। সজনে পাতা, পুদিনা পাতা, লেটুস পাতা, ধনে পাতা, ২-৩টি আমলকি একসাথে ব্লেন্ড করে গ্রীন জুস তৈরি করতে হবে। স্বাদের জন্য অল্প পরিমাণে জিরা, আদা, হিমালয়ান সল্ট, লেবু, মধু প্রভৃতি নিতে পারেন।

✅ দুপুর ০২:০০-০৩:০০ টা : ২-১ ধরনের কম মিষ্টি ফল, টক ফল অথবা, এক বাটি কাঁচা সালাদ খান। শসা, গাজর, টমেটো, ক্যাপসিকাম, বিটরুট প্রভৃতি দিয়ে সালাদ তৈরি করতে পারেন। স্বাদের জন্য হিমালয়ান সল্ট, পেঁয়াজ, মরিচ, লেবু, টক দই, সস দিতে পারেন।

✅ বিকাল ০৪:০০-০৫:০০ টা : মিক্সড সবজি (অর্ধসেদ্ধ), ডাল, ডিম (কুসুম ছাড়া) দিয়ে পরিমিত লাল চালের ভাত। ভাত খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিটের মধ্যে পানি পান থেকে বিরত থাকুন।

✅ সন্ধ্যার পরে ৩০ মিনিট হাঁটুন অথবা ১০ মিনিট জগিং করুন।

✅ রাত ৮:০০ টা: এক কাপ পরিমাণ জবের ছাতু পানির সাথে মিশিয়ে খান। স্বাদের জন্য সামান্য পরিমাণে মধু বা আখের গুড় মিশিয়ে নিতে পারেন।

✅ রাত ৯:০০ টা : অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার উইথ মাদার (৩-৪ চা চামচ) এক গ্লাস কুসুম গরম পানির সাথে মিশিয়ে খেয়ে নিন। চাইলে অল্প পরিমানে লেবুর রস মেশাতে পারেন।

দ্রষ্টব্য : আপনার সুবিধামতো সময়ে সপ্তাহে অন্তত ২-৩ দিন ১ চা চামচ মধু, আধা চা চামচ কালোজিরা, এক কোয়া রসুন ও এক টুকরো কাঁচা হলুদ খান। এছাড়াও চিয়া বীজ- ২ চা চামচ ও তিসি- ৫ চা চামচ একত্রে পানিতে ভিজিয়ে পান করুন।

করণীয়:
👉 স্ব-স্ব ধর্মের বিধি অনুযায়ী নিয়মিত প্রার্থনা করুন।
👉 সপ্তাহে ২ দিন রোজা/উপবাস/ফাস্টিং করুন।
👉 তেল ছাড়া খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
👉 নিয়মিত মেডিটেশন (ধ্যান) করুন।
👉 হার্ট ব্লকেজ থাকলে প্রাণীজ প্রোটিন যেমন সকল ধরনের মাছ, মাংস এবং দুধ ও দুধের তৈরি খাবার খাওয়া অন্তত দুই বছরের জন্য বন্ধ রাখুন।
👉 শরীরে অতিরিক্ত চর্বি ও ওজন বেশি হলে কাঙ্ক্ষিত ওজন অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বড় মাছ, মাংস, তেল ও তৈলাক্ত সব ধরনের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

বর্জনীয়:
👉 চিনি, সাদা চাল ও সাদা আটার তৈরি সকল খাবার (পাউরুটি, বিস্কুট, নুডুলস, চিপস, লুচি, পরাটা)।
👉 মিষ্টান্ন, মিষ্টি দই, ঘি, মাখন, ডালডা, মার্জারিন, দুধের সর।
👉 রেড মিট অর্থাৎ গরু-খাসি-পাঁঠার মাংস, বিরিয়ানি, কাচ্চি, তেহারি।
👉 চিংড়ি, কাঁকড়া, বড় মাছের মাথা, চাষের মাছ, ফার্মের মুরগী, কীটনাশকযুক্ত সবজি।
👉 ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক্স।
👉 প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত এবং ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত সব ধরনের খাবার।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না