স্বাস্থ্য ডেস্ক রিপোর্ট: ফ্যাটি লিভার ‘হেপাটিক স্টেটোসিস’ নামেও পরিচিত। যকৃতে চর্বি জমা হলে সেটিকে ফ্যাটি লিভার বলে। লিভারে অল্প পরিমাণ চর্বি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু অতিরিক্ত চর্বি জমে গেলে তা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
ফ্যাটি লিভার সাধারণত ২ ধরনের হয়ে থাকে। একটি হলো অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার এবং আরেকটি হলো নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার।
অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার সাধারণত যাদের অ্যালকোহল পান করার করার অভ্যাস আছে নিয়মিত, তাদের হয়ে থাকে৷
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার সাধারণত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত চিনি, কার্বোহাইড্রেট, প্রসেসড ফুড, মুখরোচক খাবার বা অতিরিক্ত মসলাদার খাবার গ্রহণের ফলে হয়ে থাকে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে। ডায়াবেটিক বা রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা বেশি থাকলেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে৷ আবার একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর অনেকে বংশগত কারণেও ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হতে পারেন।
আমাদের দেশের মানুষের নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারেন না যে লিভারে ফ্যাট জমলে তা গুরুতর আকার নেয়। ফ্যাটি লিভার থেকে প্রথমে হেপাটাইটিস বা লিভারের প্রদাহ হয়। এরপর তা লিভার সিরোসিসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তবে শুরুতেই ফ্যাটি লিভারের লক্ষণগুলো জানতে পারলে অনেক গুরুতর সমস্যার সমাধান হতে পারে।
ঝুঁকিতে আছেন যারা-
● টাইপ টু ডায়াবেটিস আছে যাদের
● মেনোপজ শুরু হয়েছে এমন নারীদের
● স্থূলতা আছে যাদের
● শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা যাদের বেশি
● দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন যারা
ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ-
● অনিয়ন্ত্রিত বা অনিয়মিত খাদ্যাভাসের ফলে লিভারের ওপর চাপ পড়ে। ফলে হজমে সমস্যা হয় ও খাবারে অরুচি চলে আসে।
● খাবার সময় বমি বমি ভাব হতে পারে
● অনেক সময় পেট ফুলে যেতে পারে
● পেট ফুলে যাওয়ার সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুলে যেতে পারে
● হঠাৎ করেই ওজন কমে যেতে পারে
● ফ্যাটি লিভারের সমস্যা হলে মাথাব্যথা, ডিপ্রেশন বা মন খারাপ এসবও হতে পারে
যে ধরনের খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে-
● অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে যারা আক্রান্ত আছেন, তাদের প্রথমেই অ্যালকোহল গ্রহণ করা বন্ধ করতে হবে।
● আপনার যদি দুধ চা খাওয়ার অভ্যাস থাকে বা কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে তৈরি চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকে তাহলে সেই অভ্যাস পরিহার করতে হবে। ঘন দুধের তৈরি খাবার বা ফুলক্রিম মিল্ক খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
● ফ্যাটি লিভার দূর করতে খাদ্যতালিকায় অবশ্যই ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে।
●ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার আপনার হজমে সাহায্য করবে, ক্ষুধাটাকে দমিয়ে রাখবে এবং আপনার পেট অনেক বেশি সময় পর্যন্ত ভরা থাকবে৷ তাই খাদ্যতালিকায় অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে।
● বিভিন্ন রঙের শাকসবজি খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। যেমন – বিটরুট, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, শিম, বরবটি, ব্রকলি ইত্যাদি। এছাড়াও আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় শাক পাওয়া যায়। আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন যেকোনো একটি দেশীয় শাক।
● অনেকেই ভেবে থাকেন ফ্যাটি লিভার হলে প্রোটিন গ্রহণ একদমই কমিয়ে দিতে হবে। এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। আপনাকে অবশ্যই উন্নত মানের প্রোটিন খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। তবে কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন – যে মাছটি খাচ্ছেন সেই মাছের একেবারে চর্বির অংশটি বাদ দিয়ে খেতে হবে। অনেকেই মুরগির চামড়া খেতে পছন্দ করেন, তবে ফ্যাটি লিভার হলে অবশ্যই মুরগি চামড়া ছাড়িয়ে খেতে হবে৷ আপনি মাঝেমধ্যে গরুর মাংস খেতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে চর্বির অংশটি বাদ দিয়ে শুধু সলিড ১ বা ২ টুকরো মাংস খেতে পারবেন ১ বেলা।
● আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একটি সেদ্ধ ডিম রাখতে পারেন। ডেইরি প্রোডাক্টের এর মধ্যে খেতে পারেন টক দই, নন ফ্যাট মিল্ক।
● এছাড়াও দেশীয় মৌসুমী বিভিন্ন ফল আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করতে পারেন।
● খাবার তৈরিতে তেলের ব্যবহার কমাতে হবে। অতিরিক্ত তৈলাক্ত ও মসলাজাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
ফ্যাটি লিভারের প্রাকৃতিক চিকিৎসা- রিভার্সাল ডায়েট
(হৃদরোগ/উচ্চ রক্তচাপ/ফ্যাটি লিভার/ডায়াবেটিস নিরাময়ের জন্য এটি পরীক্ষিত পদ্ধতি)
✅ ঘুম থেকে উঠেই (সূর্যোদয়ের পূর্বে) খালি পেটে অন্তত দুই গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করুন। আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে, সূর্যোদয়ের পুর্বে খালি পেটে জলপান করাকে ঊষাপান বলে। এইরূপ জলপান অভ্যাস করলে বাত-পিত্ত-কফজনিত যাবতীয় পীড়া, বিশেষত: অর্শ, শোথ, গ্রহণী, জীর্ণজ্বর, উদর কুষ্ঠ, মেদোরোগ, মুত্রাঘাত, কর্ণরোগ, শিরোরোগ, চক্ষুরোগ, কটিশূল এবং জরা নিবারিত হয়। এতে শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে যায়। ঠাণ্ডা জলের পরিবর্তে হালকা গরম জল পানে শরীরের আর্দ্রতা বজায় থাকে।
✅ ঊষাপানের ১০-১৫ মিনিট পরে আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা বাদাম, বীজ, ছোলা, আদা, খেঁজুর প্রভৃতি খেয়ে নিন। পরিমাণ-
বাদাম: চীনা বাদাম- ৫টি, কাঠ বাদাম- ৫টি, পেস্তা বাদাম- ৫টি, কাজু বাদাম- ২টি, আখরোট- ১টি; বীজ- মিষ্টি কুমড়ার বীজ- ১০টি, সূর্যমুখীর বীজ- ১০টি; ছোলা- ২০টি; আদা- ১ টুকরো, খেঁজুর- ১টি।
✅ ভোর ৬:০০-৭:০০ টা পর্যন্ত শারীরিক পরিশ্রম/ব্যায়াম ও ইয়োগা করুন।
✅ সকাল ৮:০০ টা : মিক্সড সবজি (অর্ধসেদ্ধ), শাক, ভর্তা দিয়ে ২-৩টি লাল আটার রুটি অথবা, পরিমিত লাল চালের ভাত/খিচুড়ি। রুটি বা ভাত খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিটের মধ্যে পানি পান করা থেকে বিরত থাকুন।
✅ বেলা ১১:০০ টা : অন্তত দুই ধরনের সাইট্রাস ফল যেমন লেবু, মোসাম্বি লেবু, কমলা লেবু, আঙুর, মালটা, জাম্বুরা প্রভৃতি খান।
✅ দুপুর ১২:০০-০১:০০ টা : এক গ্লাস গ্রীন জুস তৈরি করে পান করুন। সজনে পাতা, পুদিনা পাতা, লেটুস পাতা, ধনে পাতা, ২-৩টি আমলকি একসাথে ব্লেন্ড করে গ্রীন জুস তৈরি করতে হবে। স্বাদের জন্য অল্প পরিমাণে জিরা, আদা, হিমালয়ান সল্ট, লেবু, মধু প্রভৃতি নিতে পারেন।
✅ দুপুর ০২:০০-০৩:০০ টা : ২-১ ধরনের কম মিষ্টি ফল, টক ফল অথবা, এক বাটি কাঁচা সালাদ খান। শসা, গাজর, টমেটো, ক্যাপসিকাম, বিটরুট প্রভৃতি দিয়ে সালাদ তৈরি করতে পারেন। স্বাদের জন্য হিমালয়ান সল্ট, পেঁয়াজ, মরিচ, লেবু, টক দই, সস দিতে পারেন।
✅ বিকাল ০৪:০০-০৫:০০ টা : মিক্সড সবজি (অর্ধসেদ্ধ), ডাল, ডিম (কুসুম ছাড়া) দিয়ে পরিমিত লাল চালের ভাত। ভাত খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিটের মধ্যে পানি পান থেকে বিরত থাকুন।
✅ সন্ধ্যার পরে ৩০ মিনিট হাঁটুন অথবা ১০ মিনিট জগিং করুন।
✅ রাত ৮:০০ টা: এক কাপ পরিমাণ জবের ছাতু পানির সাথে মিশিয়ে খান। স্বাদের জন্য সামান্য পরিমাণে মধু বা আখের গুড় মিশিয়ে নিতে পারেন।
✅ রাত ৯:০০ টা : অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার উইথ মাদার (৩-৪ চা চামচ) এক গ্লাস কুসুম গরম পানির সাথে মিশিয়ে খেয়ে নিন। চাইলে অল্প পরিমানে লেবুর রস মেশাতে পারেন।
দ্রষ্টব্য : আপনার সুবিধামতো সময়ে সপ্তাহে অন্তত ২-৩ দিন ১ চা চামচ মধু, আধা চা চামচ কালোজিরা, এক কোয়া রসুন ও এক টুকরো কাঁচা হলুদ খান। এছাড়াও চিয়া বীজ- ২ চা চামচ ও তিসি- ৫ চা চামচ একত্রে পানিতে ভিজিয়ে পান করুন।
করণীয়:
👉 স্ব-স্ব ধর্মের বিধি অনুযায়ী নিয়মিত প্রার্থনা করুন।
👉 সপ্তাহে ২ দিন রোজা/উপবাস/ফাস্টিং করুন।
👉 তেল ছাড়া খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
👉 নিয়মিত মেডিটেশন (ধ্যান) করুন।
👉 হার্ট ব্লকেজ থাকলে প্রাণীজ প্রোটিন যেমন সকল ধরনের মাছ, মাংস এবং দুধ ও দুধের তৈরি খাবার খাওয়া অন্তত দুই বছরের জন্য বন্ধ রাখুন।
👉 শরীরে অতিরিক্ত চর্বি ও ওজন বেশি হলে কাঙ্ক্ষিত ওজন অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বড় মাছ, মাংস, তেল ও তৈলাক্ত সব ধরনের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
বর্জনীয়:
👉 চিনি, সাদা চাল ও সাদা আটার তৈরি সকল খাবার (পাউরুটি, বিস্কুট, নুডুলস, চিপস, লুচি, পরাটা)।
👉 মিষ্টান্ন, মিষ্টি দই, ঘি, মাখন, ডালডা, মার্জারিন, দুধের সর।
👉 রেড মিট অর্থাৎ গরু-খাসি-পাঁঠার মাংস, বিরিয়ানি, কাচ্চি, তেহারি।
👉 চিংড়ি, কাঁকড়া, বড় মাছের মাথা, চাষের মাছ, ফার্মের মুরগী, কীটনাশকযুক্ত সবজি।
👉 ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংক্স।
👉 প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত এবং ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত সব ধরনের খাবার।