আয়ুর্বেদে ডায়াবেটিসের প্রাকৃতিক ও সমন্বিত চিকিৎসা

কামরুল ইসলাম

ডায়াবেটিস মেলিটাস বর্তমানে একটি বিশ্বজনীন স্বাস্থ্য সমস্যা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির পরেও অনেক মানুষ এই রোগের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় ভুগছেন। তবে, আয়ুর্বেদ – প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র – দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিসকে (যাকে আয়ুর্বেদে ‘মধুমেহ’ বলা হয়) প্রাকৃতিক ও জীবনঘনিষ্ঠ পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় বলে আসছে। এই প্রবন্ধে আমরা আয়ুর্বেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ডায়াবেটিসের কারণ, লক্ষণ ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।

আয়ুর্বেদের মতে ডায়াবেটিসের কারণ

আয়ুর্বেদে ডায়াবেটিসকে মূলত “মধুমেহ” নামে অভিহিত করা হয়, যা ২০ প্রকার মেহ রোগের একটি। এটি মূলত দোষসমূহের (বায়ু, পিত্ত ও কফ) ভারসাম্যহীনতা এবং বিশেষ করে বায়ু ও কফ দোষের অস্বাভাবিকতা থেকে উদ্ভূত। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অলস জীবনযাপন, অতিরিক্ত মিষ্টিজাত খাবার গ্রহণ, অতিরিক্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ এই রোগের মূল উৎস।

মধুমেহের লক্ষণ

  • অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়া
  • অতিরিক্ত তৃষ্ণা ও ক্ষুধা
  • দেহে দুর্বলতা ও ক্লান্তি
  • ওজন কমে যাওয়া (টাইপ ১ ডায়াবেটিসে) অথবা ওজন বেড়ে যাওয়া (টাইপ ২ ডায়াবেটিসে)
  • ক্ষত সৃষ্ট হলে দেরিতে শুকানো
  • চোখে ঝাপসা দেখা

আয়ুর্বেদের প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি

১. ঔষধি গাছ ও ভেষজ প্রয়োগ

  • জামুন (Syzygium cumini): জামুনের বীজ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। শুকনো করে গুঁড়া করে খালি পেটে গ্রহণ করা হয়।
  • করেরা (Momordica charantia): করেলা একটি স্বীকৃত প্রাকৃতিক ইনসুলিন। রস করে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • মেথি (Fenugreek): এটি রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে সহায়ক। ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খাওয়া যায়।
  • গুড়মার (Gymnema sylvestre): এটি “sugar destroyer” নামে পরিচিত। এটি ইনসুলিন উৎপাদনে সহায়ক।

২. আহার ও বিহার (জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস)

  • নিয়মিত সময়মতো খাবার গ্রহণ
  • পরিমিত কার্বোহাইড্রেট ও উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া
  • শস্য জাতীয় খাবার (যেমন যব, বাজরা, ব্রাউন রাইস)
  • তাজা শাকসবজি ও অম্ল জাতীয় ফল
  • ঘি ও নারকেল তেল পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ
  • অতিরিক্ত চিনিযুক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা

৩. যোগ ও প্রাণায়াম

  • যোগাসন: বজ্রাসন, ধনুরাসন, মায়ূরাসন, পবনমুক্তাসন ইত্যাদি রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • প্রাণায়াম: অনুলোম-বিলোম, কপালভাতি এবং ভ্রমরী প্রাণায়াম নিয়মিত করলে দেহের হরমোনাল ভারসাম্য রক্ষা হয়।
  • প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটা

৪. পঞ্চকর্ম চিকিৎসা

আয়ুর্বেদে “পঞ্চকর্ম” অর্থাৎ পাঁচটি বিশুদ্ধকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে দেহ থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করা হয়। এটি বিশেষজ্ঞ আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়।

আধুনিক ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা একসাথে গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে। আয়ুর্বেদের মূল দর্শন হলো – রোগ হওয়ার আগে প্রতিরোধ। সুতরাং, আয়ুর্বেদ অনুসরণ করে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন ও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারে ডায়াবেটিস যেমন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।

কামরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর। পেশায় লেখক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। বগুড়ার টিএমএসএস-ফিরোজা বেগম আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজের ১০ম ব্যাচের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের একজন শিক্ষার্থী।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না