সাকির হোসেন
মানুষের সুস্থ জীবনের অন্যতম উপাদান হলো শরীর ও মনের ভারসাম্য। এই ভারসাম্য বজায় রাখতে যোগব্যায়ামের ভূমিকা আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, মানসিক চাপ ও দেহগত জড়তা কাটিয়ে উঠতে যোগব্যায়াম এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত চিকিৎসা ও রিল্যাক্সেশন পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই যোগব্যায়ামের এক সহজ, নিরাপদ ও কার্যকর আসন হলো সুখাসন। নামেই বোঝা যায়, এটি একটি ‘সুখের আসন’—দীর্ঘক্ষণ শান্তভাবে বসে থাকার এক অনন্য উপায়।
সুখাসনের পদ্ধতি:
সুখাসন করতে চাইলে প্রথমেই প্রয়োজন একটুকরো সমতল ও নরম আসন বা যোগম্যাট। নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে এটি অনুশীলন করা হয়:
- সোজাভাবে বসা: মাটিতে পা গুটিয়ে সামনের দিকে দুই পা ভাঁজ করে বসুন। বাম পায়ের গোড়ালি ডান ঊরুর নিচে এবং ডান পায়ের গোড়ালি বাম ঊরুর নিচে রাখুন। দু’টি হাঁটু মাটির সঙ্গে স্পর্শ থাকবে।
- মেরুদণ্ড সোজা রাখা: পিঠ সোজা, মাথা স্বাভাবিকভাবে উঁচু এবং কাঁধ ঢিলেঢালা রাখতে হবে।
- হাতের অবস্থান: দুই হাঁটুর ওপর হাত রাখুন, আঙুলগুলো ধ্যানমুদ্রা বা জ্ঞানমুদ্রায় রাখতে পারেন—অর্থাৎ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী একসাথে, বাকিগুলো সোজা।
- নির্বিঘ্ন শ্বাস-প্রশ্বাস: চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস নিতে নিতে মনকে শান্ত করতে হবে। মনোযোগ থাকবে শ্বাসের ওপর।
- সময়সীমা: প্রাথমিকভাবে ৫ থেকে ১০ মিনিট বসে থাকা যাবে, ধীরে ধীরে সময় বাড়ানো যেতে পারে ১৫–৩০ মিনিট পর্যন্ত।
সুখাসনের উপকারিতা:
সুখাসন শুধু শারীরিক কসরত নয়, এটি মানসিক প্রশান্তিরও এক চাবিকাঠি। এর রয়েছে অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা:
১. মনের প্রশান্তি ও মানসিক চাপ হ্রাস:
সুখাসনে বসে ধ্যান বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের চর্চা মানসিক শান্তি আনতে সহায়ক। একে “মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন”-এর একটি প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ধরা হয়।
২. মেরুদণ্ড ও ঘাড়ের সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখে:
এই আসনে নিয়মিত চর্চা করলে মেরুদণ্ড সোজা থাকে, ফলে ঘাড় ও পিঠের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৩. পাচনতন্ত্র উন্নত করে:
সুখাসনে বসে খাওয়া বা বিশ্রাম নিলে হজম শক্তি বাড়ে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। ভারতীয় আয়ুর্বেদ মতে, এই আসন অন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
৪. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে:
মন শান্ত থাকলে স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা কমে আসে, ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
৫. ধ্যান ও প্রার্থনার উপযুক্ত আসন:
বিভিন্ন ধর্মীয় ধ্যান, মন্ত্রপাঠ, কিংবা প্রার্থনার সময় এই আসন গ্রহণ করলে মনোসংযোগ বাড়ে।
৬. জয়েন্ট ও পেশি নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়:
হিপ জয়েন্ট, হাঁটু ও গোড়ালির পেশির নমনীয়তা বৃদ্ধি পায় নিয়মিত চর্চায়। বয়সভেদে সহজভাবে বসে থাকার ক্ষমতা বাড়ে।
কে করতে পারবেন, কে পারবেন না?
সুখাসন যেহেতু একটি সহজ আসন, তাই প্রায় সব বয়সের মানুষ এটি অনুশীলন করতে পারেন। তবে যাদের হাঁটু বা হিপ জয়েন্টে গুরুতর সমস্যা রয়েছে, কিংবা অপারেশনের পরবর্তী সময় কাটাচ্ছেন—তাদের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কিছু বাড়তি টিপস:
- সকালবেলা বা সন্ধ্যাবেলা ফাঁকা পেটে সুখাসন করলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
- টানা বসে থাকতে গেলে প্রথমে ব্যথা বা অস্বস্তি লাগতে পারে, তবে নিয়মিত অভ্যাসে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
- ধ্যান বা শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন করলে এ আসন আরও কার্যকর হয়ে ওঠে।
সুখাসন শুধু একটি যোগাসন নয়, বরং এটি এক ধরনের ‘সুখময় জীবনব্যবস্থা’র প্রতীক। শারীরিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক সংযোগের মেলবন্ধনে সুখাসনের ভূমিকা অনন্য। এ আসন শুধু যোগব্যায়ামের অংশ হিসেবে নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠতে পারে—ক্লান্ত শরীর ও উত্তেজিত মনকে প্রশান্ত করার এক সহজ পথ।
আজকের দিনে যখন মানুষ নানা চাপ ও উদ্বেগে জর্জরিত, তখন সুখাসনের মতো একটি সরল চর্চা হতে পারে জীবনের পরম শান্তির চাবিকাঠি।
সাকির হোসেন: লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশ যোগ ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু। বর্তমানে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, নগরবাড়ি অডিট এন্ড কোয়ালিটি ডেভেলপমেন্ট অফিসার পদে কর্মরত আছেন।
প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, এভারগ্রীন ফিটনেস কমিউনিটি (যোগব্যায়াম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র)
ধোবাখোলা করোনেশন স্কুল এন্ড কলেজ মাঠ, নাটিয়াবাড়ি, আমিনপুর-বেড়া, পাবনা।