পাইলস বা অর্শ রোগ: আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় কারণ ও করণীয়

কামরুল ইসলাম

পাইলস, যা বাংলায় ‘অর্শ রোগ’ নামে পরিচিত, একটি সাধারণ কিন্তু কষ্টদায়ক পায়ুপথজনিত সমস্যা। নগরায়নের জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও দীর্ঘসময় বসে কাজ করার ফলে এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পাইলসের জন্য একটি স্বাভাবিক, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এবং কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আয়ুর্বেদের মূল দর্শন হলো—প্রকৃতি ও শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা, যাতে স্বয়ং শরীর নিজেই রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হয়।

এই প্রবন্ধে পাইলস রোগের আয়ুর্বেদ অনুসারে কারণ, লক্ষণ এবং প্রাকৃতিক উপায়ে চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

পাইলস কী?

পাইলস হলো মলদ্বারে বা তার আশপাশে শিরার স্ফীতি, যা কখনও রক্তপাতের কারণ হয়, আবার কখনও তীব্র ব্যথা ও অস্বস্তির। এটি দুই ধরনের হয়:

  1. আভ্যন্তরীণ পাইলস (Internal Hemorrhoids): মলদ্বারের ভিতরে থাকে, সাধারণত রক্তপাত হয় কিন্তু ব্যথা থাকে না।
  2. বাহ্যিক পাইলস (External Hemorrhoids): বাইরে ফোলা দেখা যায়, অনেক সময় অতিরিক্ত ব্যথা, চুলকানি ও রক্তপাত হয়ে থাকে।

আয়ুর্বেদ মতে পাইলসের কারণ

আয়ুর্বেদ অনুযায়ী, মানবদেহ তিনটি দোষ বা শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়: বাত, পিত্ত, কফ। এই তিন দোষের ভারসাম্যহীনতাই পাইলসসহ বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। পাইলস মূলত বাত ও পিত্ত দোষের অতিশক্তি থেকে উদ্ভূত হয়। আয়ুর্বেদ মতে কিছু মূল কারণ নিচে দেওয়া হলো:

  1. অতিরিক্ত মসলাযুক্ত ও ঝাল খাবার খাওয়া
  2. জলখাবার বাদ দিয়ে অনিয়মিত খাবার গ্রহণ
  3. দীর্ঘসময় বসে থাকা ও অলস জীবনযাপন
  4. মলত্যাগে বেশি চাপ দেওয়া
  5. কোষ্ঠকাঠিন্য বা অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা
  6. অপর্যাপ্ত পানি পান করা
  7. পুষ্টিকর খাবারের অভাব ও অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া

লক্ষণসমূহ

  • মলত্যাগের সময় রক্ত পড়া
  • পায়ুতে চুলকানি, জ্বালাপোড়া
  • মলদ্বারের আশপাশে ফোলা বা গুটির মতো অংশ
  • অতিরিক্ত ব্যথা ও অস্বস্তি
  • কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেট ফাঁপা

আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি

আয়ুর্বেদ চিকিৎসা মূলত প্রাকৃতিক ভেষজ, খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, জীবনপদ্ধতির পরিবর্তন ও শরীরের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করে। নিচে কিছু কার্যকর আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি তুলে ধরা হলো:

ত্রিফলা চূর্ণ (Triphala Churna):

ত্রিফলা হল হারিতকী, বিভীতকী ও আমলকীর মিশ্রণ। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ও মলদ্বার পরিষ্কার রাখে। প্রতিদিন রাতে এক গ্লাস কুসুম গরম পানির সঙ্গে এক চা চামচ ত্রিফলা চূর্ণ খেলে উপকার মেলে।

অর্শকুটারী রস (Arshkuthar Ras):

পাইলসের ব্যথা ও রক্তপাত কমাতে এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর আয়ুর্বেদিক ট্যাবলেট। রোগের ধরন বুঝে নির্দিষ্ট মাত্রায় গ্রহণ করতে হয়।

কাঁচা কলা ও তিল:

পাকা কলার বদলে কাঁচা কলা সিদ্ধ করে খাওয়া, কিংবা তিল সেদ্ধ করে খেলে অন্ত্রের গঠন মজবুত হয় ও মল সহজে ত্যাগ হয়।

রক্ত স্তম্ভক ভেষজ (Nagkesar, Neem, Haritaki):

এগুলো রক্তপাত কমাতে সাহায্য করে ও ফোলা অংশ শুকিয়ে দেয়। এগুলোর গুঁড়া নির্দিষ্ট মাত্রায় মধু বা ঘৃতের সঙ্গে খেতে হয়।

সিতোপলাদী চূর্ণ:

পায়ুর জ্বালাপোড়া ও চুলকানি কমাতে সহায়ক। হালকা গরম দুধের সঙ্গে খাওয়া হয়।

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন

আয়ুর্বেদে খাদ্যকে “ঔষধের প্রথম স্তম্ভ” বলা হয়। তাই খাদ্য তালিকায় নিচের বিষয়গুলো রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়:

✅ প্রচুর পরিমাণে পানি পান
✅ আঁশযুক্ত সবজি ও ফলমূল (পেপে, ঢেঁড়স, আমলকী)
✅ দুধ ও ঘৃতযুক্ত হালকা খাদ্য
❌ তেল-মসলা ও ফাস্টফুড বর্জন
❌ অতিরিক্ত ঝাল ও ভাজাপোড়া নিষিদ্ধ

জীবনধারায় করণীয়

☀️ সকালে নিয়মিত হাঁটা ও হালকা যোগব্যায়াম
🧘‍♂️ প্রতিদিন সুখাসন বা বজ্রাসন অনুশীলন
🕰️ নির্দিষ্ট সময়মতো পায়খানায় যাওয়া
🚫 মলত্যাগে জোর প্রয়োগ না করা
🪑 দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা এড়িয়ে চলা

পাইলস বা অর্শ রোগকে অবহেলা করলে তা কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও ভীষণ দুর্বল করে দেয়। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি এই রোগের শেকড় ধরেই সমাধান দেয়, যেখানে রোগ দমন নয়—রোগ নির্মূলই লক্ষ্য। আধুনিক ওষুধের পাশাপাশি আয়ুর্বেদ পদ্ধতি অনুসরণ করলে রোগ প্রতিরোধ ও পুনরাবৃত্তি রোধ সম্ভব হয়।

তবে মনে রাখা প্রয়োজন, যেকোনো আয়ুর্বেদ চিকিৎসা গ্রহণের আগে একজন অভিজ্ঞ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কামরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর। পেশায় লেখক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী। বগুড়ার টিএমএসএস-ফিরোজা বেগম আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজের ১০ম ব্যাচের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের একজন শিক্ষার্থী।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না