আলাউল হোসেন
বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কৃষিজমি বাড়ছে না। এরই মাঝে জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির অবক্ষয়, রোগবালাই এবং পানি সংকট কৃষিতে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এমন বাস্তবতায় জৈবপ্রযুক্তি বা বায়োটেকনোলজি (Biotechnology) হতে পারে আধুনিক কৃষির নির্ভরযোগ্য সমাধান।
জৈবপ্রযুক্তি শুধু উচ্চফলনশীল ফসল নয়, বরং রোগপ্রতিরোধী, খরাপ্রতিরোধী ও পুষ্টিসমৃদ্ধ কৃষি উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জৈবপ্রযুক্তি কী এবং এটি কীভাবে কৃষিতে প্রযোজ্য?
জৈবপ্রযুক্তি (Biotechnology) হলো জীববিজ্ঞানের একটি শাখা যা জৈবিক কোষ, অণুজীব ও জিনগত উপাদান ব্যবহার করে উদ্ভিদ ও প্রাণীর গঠন ও গুণগত পরিবর্তন সাধন করে। কৃষিক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করে তৈরি করা হয় উন্নত জাত, রোগমুক্ত বীজ, জৈবসার ও পরিবেশবান্ধব কীটনাশক।
কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ
🌾 জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে ফসল উন্নয়ন (Genetic Modification)
- বিটি বেগুন: ব্যাকটেরিয়ার জিন সংযোজনের মাধ্যমে কীট প্রতিরোধী
- গোল্ডেন রাইস: ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ চাল
- লবণ সহনশীল ধান: উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য উপযোগী
🌱 টিস্যু কালচার প্রযুক্তি
- একক কোষ থেকে অসংখ্য গাছ উৎপাদন
- রোগমুক্ত বীজ উৎপাদন
- কাঁঠাল, কলা, আনারস ও ফুল চাষে বহুল ব্যবহৃত
🐄 গবাদিপশুতে উন্নত জাত উন্নয়ন
- কৃত্রিম প্রজনন ও ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে দুধ ও মাংস উৎপাদনে অগ্রগতি
- রোগ প্রতিরোধী গবাদিপশু তৈরি
🦠 অণুজীব প্রযুক্তি
- জৈবসার ও জৈব কীটনাশকে অণুজীব ব্যবহার
- নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়া মাটির উর্বরতা বাড়ায়
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জৈবপ্রযুক্তির সম্ভাবনা
বাংলাদেশে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI), জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (IGBB) এর নেতৃত্বে দেশীয় জলবায়ু উপযোগী জিএম ফসল উদ্ভাবিত হচ্ছে।
- বিটি বেগুন ইতোমধ্যে কৃষকের ঘরে ঘরে পৌঁছেছে
- গোল্ডেন রাইস চাষের অনুমতি আসন্ন
- উচ্চফলনশীল টিস্যু-কালচার আলু ও কলা সফলভাবে বাজারজাত হচ্ছে
- বায়োফার্টিলাইজার উৎপাদনে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ বাড়ছে
জৈবপ্রযুক্তির সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
✅ সুবিধাসমূহ:
- ফলন বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ হ্রাস
- পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে কৃষি উন্নয়ন
- পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল
- রোগ ও পরিবেশ প্রতিকূলতা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
⚠️ চ্যালেঞ্জসমূহ:
- জনসচেতনতার ঘাটতি ও প্রযুক্তিভীতি
- জিএম ফসল নিয়ে নৈতিক ও নিরাপত্তা বিতর্ক
- দক্ষ মানবসম্পদের অভাব
- বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগের ঘাটতি
ভবিষ্যৎ নির্দেশনা ও করণীয়
- কৃষক প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি
- বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কৃষি বায়োটেকনোলজি শিক্ষা বিস্তার
- সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে গবেষণা ত্বরান্বিত করা
- নীতিগত ও নৈতিক কাঠামো তৈরি করে নিরাপদ ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ
কৃষি বাংলাদেশের প্রাণ, আর প্রযুক্তিই কৃষির ভবিষ্যৎ। জৈবপ্রযুক্তি আমাদের কৃষিকে টেকসই, নিরাপদ ও আধুনিক করার এক বাস্তব হাতিয়ার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল বাস্তবতায় আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে জৈবপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, গবেষণা ও সচেতনতা অপরিহার্য।
আজকের সিদ্ধান্তই আগামী প্রজন্মের খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি।