বাউল কবি জিতেন্দ্রনাথের গান ও তার মর্মকথা

আলাউল হোসেন

মানুষ জীবন নিয়ে ভাবে, এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জীবনের সরল রৈখিক নৈর্ব্যক্তিক ভাবনা সকল মানুষ একই ধারায় ভাববে এমনটি হয়তো হবার কথা নয়। আমরা কেউ কেউ ঐশ্বর্য নিয়ে ভাবি। কেউ সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে ভাবি। এমন বিভিন্ন প্রকার ভাব্য-ভাবনায় দ্বিমুখী ধারায় কেউ আবার মুক্তচিন্তায় জীবনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভাবি। জীবন নিয়ে ব্রহ্মজিজ্ঞাসায় কেউ আবার জীবন পরিচালকের সঠিক অস্বিত্ব খুঁজতে গিয়ে দর্শন ভাবনা ভাবেন। এমন একজন মানুষ বাউল কবি জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী।

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ সমাপ্ত করে বাবা প্রাণনাথ হালদারের সাথে পদ্মা, যমুনা ও ইছামতি নদীতে মাছ ধরার পেশায় লেগে যান জিতেন। লেখাপড়া এখানেই ক্ষান্ত। নৌকায় ঘর সংসার এবং রাত্রিযাপন। নিদ্রাদেবীর কোলে এলিয়ে দেবার আগে বালক জিতেন গলা ছেড়ে আপন মনে নিজের রচনা করা গান গাইতেন। বালক জিতেনের গানের বাণী আর সুরে ওস্তাদ হরিপদ সরকার মুগ্ধ হয়ে জিতেনকে আপন করে নেন। তারপর ওস্তাদ হরিপদ সরকারের নিকট ধর্মীয় পাঠ, ধর্মীয় আলোচনা, সংগীত চর্চা, জারি ও সারিগান, কবিগান, পালাগান ইত্যাদি বিষয়ে তালিম গ্রহণ করে মাত্র ২৪ বছর বয়সে কবি গানের পালায় নাম লেখান। তরণী সরকার, শশধর সরকার, চাঁদুল্লাহ সরকার, মন্তাজ সরকার, বিরেন সরকার, নিত্যানন্দ সরকার প্রমুখ করিয়ালদের সঙ্গে বিভিন্ন জেলায় কবিগান করেছেন। গান রচনায় জিতেন্দ্রনাথ সরকার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি গানের বাণী, ছন্দ এবং রূপে কবিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বিশুদ্ধ বাউলতত্ত্ব জানার জন্য তিনি পাগল সুধীরচাঁদ গোস্বামীর নিকট উপাসনা গ্রহণ করেন। চৈতন্যগুরু সুধীরচাঁদ তাঁকে গুরুর আসন দিয়ে কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী নাম প্রদান করেন। বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী ১৩২৫ বঙ্গাব্দে ১৪ই পৌষ রবিবার বেড়ার নাকালিয়া নিকটবর্তী সাঁড়াশিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম প্রাণনাথ হালদার এবং মাতার নাম শুভাশিনী হালদার। এক সময় সাঁড়াশিয়া গ্রাম যমুনা নদীর করাল গ্রাসে গেলে তাঁর পিতা বেড়া থানার বনগ্রাম উত্তর (চরপাড়া) গ্রামে নতুন বসত করেন। তখন বাউল কবির বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছর। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতে অনেক শিষ্য, গুণগ্রাহী এবং চার পুত্র, দুই কন্যা ও নাতিপুতির মায়া ত্যাগ করে ৩০ জৈষ্ঠ্য ১৪২৩ বঙ্গাব্দে বরিবার রাত্রি ১টা ৪১ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ বিশুদ্ধচিন্তা: ১ম খণ্ড (গানের বই)। এই বাউল কবির বাউলিয়ানা জীবনে রচিত ছয় শতাধিক গানের সমাহার থেকে কয়েকটি গানের দুই একটি চরণের ব্যাখ্যা করা হল মাত্র।

জীবন আর পরমের সহবস্থানে মানব দেহ। পরমের অবস্থান মানব দেহের সহ¯্রদলে। সেই পরমই মানবদেহে বিন্দু রূপে ঈশাণ কোণে অবস্থান করে। শিবসংহিতায় বলা হয়, ‘ঈশানে ঈশ্বরত্ব কিছু ধারণাৎ।’ বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী এই মানব দেহকে ঘর হিসাবে তুলনা করেছেন। যে ঘরে জীব আর পরমের সহাবস্থান। সেই পরম অতি নিকটে শুনেও তাকে চিনতে পারেনি, তার সাথে কবির কোনো সম্বন্ধ নেই, যে কথা কবি তার গানের বাণীতে ব্যক্ত করেছেন :
এক ঘরে বাস করো দুইজন
আপন জনকে চিনলে নারে মন
তার সাথে তোর নাই সম্বন্ধ
সে জন দূরে নয় লক্ষ যোজন ॥

জীব মানেই মহাবীজের বীজধারণকারী সত্তা। সেই সত্তা বা জ্যোতির্ময় বস্তুকে মহাজনের ধন বলা হয়। অনেকেই পাড়ের কড়ি বলে থাকি। আমরা যা নিয়ে এসেছি তাই ষোল আনা কড়ি রূপে মহাজনের হালখাতায় অর্থাৎ তার হিসাব কার্যের দিন পুরোটাই ফেরত দিতে হবে। বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী তার গানের বাণীতে সেই ষোল আনা ক্যাশ ফেরত দিতে না পাড়লে জীবকে অধগতিতে পতিত হতে হবে সেই কথাই বলেছেন এইভাবে :
মহাজনের ধন এনোছো
কি জব দিবে হালখাতায়
ষোল আনা ক্যাশ না দিলে
তোমার নাম যাবে খাস্তা খাতায় ॥

মানবদেহে একজন মানুষ থাকে, যাকে আমরা পরম মানুষ বলে জানি। আর মানবদেহ ঘরের সেই মানুষটি বিন্দুরূপী পরম মানুষকে উপাসনা করেন তার সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়; ঘরের মানুষকে সাধকের মনিকোঠায় রাখার আশায়। আলোর মানুষ ঘরে থাকলে ঘর আলোকিত হয়। এই কথাগুলোই বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী তার গানের কথায় গেয়েছেন :
রাখো ঘরের মানুষ ঘরে
তারে দিয়ো না বাহিরে
মানুষ রাখো যতন করে
রাখলে ঘরে চিরতরে রে
ঘরের রূপ দ্বিগুন বাড়ে ॥

মহামূল্যবান সম্পদ মহাযতনে রাখা সর্বজন স্বীকৃত। সেই মূল্যবান সম্পদ হেলায়-ফেলায় রাখলে নষ্ট হওয়া বা হারিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। মহামূল্যবান অমূল্য সম্পদের ঘাটতি হলে, রতিমাসার ঘাটতি হলে মালিকের কাছে হিসাব দেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। একারণেই বাউলকবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী তার গানের কথায় এভাবে বলেছেন :
অযতনে রাখলে নিধি
কেমনে মন হিসাব দিবি
হচ্ছে ঘাটতি নিরবধি
করলি না তার সদ-উপায় ॥

জড় জগৎ অনিত্য। মায়ার সংসারে মায়াবদ্ধ জীব হিসাবে আমরা নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আমরা মায়াবাদীরা নিজের আত্মোন্নতি নিয়ে কে কতটুকু ভাবি তা নিতান্তই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্যদিকে আত্মজ্ঞানীরা আত্মবস্তু অনুসন্ধান করে সূক্ষ্ম সাধানায় জেনেছেন কী এবং কী ধরনের উৎকর্ষতাই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায়। সেই কী এবং কী ধনকে বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী সারবস্তু হিসাবে তার গানের বাণীতে প্রকাশ করেছেন :
অনিত্য এই মায়ার সংসার
ভাবো নাই মন কোন বস্তু সার।

পৃথিবীতে আমরা এক চন্দ্রের উদয় দেখি। দেহ কেন্দ্রিক সাধনতত্ত্বে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রের কথা বলা হয়ে থাকে। আকাশ চন্দ্রের দেশে যেতে হলে রকেটযান ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দেহরূপ চন্দ্রের দেশে সেই সহস্রদল পদ্মে যেতে হলে প্রাণরূপ বাতাসের কার্যকারণ করে উর্ধ্বরেতা সাধনের কথা শোনা যায়। গুরুরূপ বায়ু নিয়ে মূলাধার হতে সহস্যদল পদ্মে চাঁদের দেশে গেলে জীবের ভববন্ধন মুক্ত হয়। বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামীর গানের বাণীতে সেই কথাই ব্যক্ত হয়েছে :
গুরুমন্ত্র অক্সিজেন নিয়ে
ছাড়না দেহ রকেট খান
তোর ভববন্ধন হইবে মোচন
পাইবি চন্দ্রের সন্ধান ॥

ষটচক্রভেদী মানবদেহ। ছয়টি চক্রকে ছয়টি স্টেশান কল্পনা করলে প্রথম স্টেশান মূলাধার। মূলবস্তুকে, জ্যোতির্ময় বস্তুকে পরমের দেশে পৌঁছাতে হলে প্রথম স্ট্রেশান থেকে প্রাণায়ামের মাধ্যমে সাধিতে সাধিতে সুষ¤œার পথ দিয়ে সহ¯্রদল পদ্মে পরম গুরুরবাড়ি যাওয়ার উপায় যোগতত্ত্বে বলা হয়ে থাকে। তবে সাধন ছাড়া সাধ্যদেশে যাওয়া সম্ভব নয়। এমন গুহ্যতত্ত্ব বিষয়ক বাণী বাউল কবির গানে আমরা দেখতে পাই এইভাবে :
সাধিতে সাধিতে সাধনা
বিনা সাধনাতে সে ধন
হাতের কাছে মিলবে না ॥

সময় গণিতের নিয়মে চলে। সঠিক সময় নিরূপণ না করে অনিয়মে কার্যসিদ্ধি কখনই সম্ভব নয়। বাউল কবিগণ আলেক মানুষ, অধর মানুষ, অধর চাঁদকে ধরার কথা তাদের গানের বাণীতে অনেকেই বলেছেন। যেমন বাউল কবি জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী সেই অধর মানুষ কে ধরার জন্য সময়কে প্রাধান্য দিয়েছেন। অষ্টকাল-অষ্টপ্রহর পাহারা দিয়ে অধর দিয়ে অধর চাঁদ ধরার কথা বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী তার গানের কথায় বলেছেন :
ধরবি যদি অধর মানুষ
করগে আগে সময় নিরূপণ
যখন তখন যায় না ধরা
সন্ধান ছাড়া হয়না কখন ॥

বাউল সম্রাট লালন ফকির বলেছেন, রসের রসিক না হলে/কে গো জানতে পায়। রস এবং রসিকের মধ্যে সম্পর্ক অতি নিবিড়। পঞ্চরসের রসিকগণ যে রসাভিযানের কথা বলে থাকেন, সে রসে কী উজ্জ্বল রস থাকে। যে উজ্জ্বল রস পেলে, যে অমৃত সুধা পেলে জীবের ক্ষুধা, তৃষ্ণা থাকে না। কোনো ভক্ত উজ্জ্বল রস পেলে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ তার হয়ে যায়। সেই কথাই বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী তার গানের বাণীতে বলেছেন :
যে পেয়েছে উজ্জ্বল রস
কৃষ্ণ চন্দ্র রয় তাহার বস
বিশ্বজুড়ে হয় তাহার যশ
প্রেম রসের কারবার ॥

ধ্যান আর ধারণা দুটি শব্দ। শব্দ দুটির অর্থও আলাদা। অথচ একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। ধারণার উত্তরণ ভাবকে আশ্রয় করেই ধ্যান। লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই সুলক্ষ্যে পৌঁছানোর নামই সাধনা। তদ্রুপ সাধন মার্গের ভক্তগণ আরূপেতে স্বরূপ দিয়ে দ্বিদল পদ্মে দৃষ্টি রেখে রূপনগরে মহানন্দে ধ্যামমগ্ন থাকেন। এমন আধ্যাত্মিক বিষয়ের কথা বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী তার গানের বাণীতে উল্লেখ করেছেন এইভাবে :
আরূপেতে স্বরূপ দিয়ে
রূপনগরে তাঁরা রয়
বিরজার পরপারে
আনন্দে সাঁতার খেলায় ॥

আমরা মায়াবদ্ধ জীব। মায়ারূপ সংসার হতে আমরা মুক্তির উপায় খুঁজেই চলছি। মায়ানদী পাড় হয়ে আমরা ওপারে যেতে চাই। শোনা যায় ওপারে যেতে হলে ভবনদী পাড় হতে হয়। সেই নদীর ঘাটের মাঝিকে ষোল আনা কড়ি দিতে না পারলে মাঝিও নদী পাড় করে দেয় না। কড়িশূন্য পাড়ার্থী পাড় ঘাটে গিয়ে আবার ফিরে এসে মায়াজালের সূতোয় বাঁধা পড়ে যায়। ধর্মীয় গ্রন্থের কথা, “পুনরূপি জনমং পুনরূপি মরনং। পুনরূপি মাতৃজঠরে স্মরণম ॥” বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী তার গানের কথায় বলেছেন :
পাড় হতে লাগে পুঁজি, নইলে মাঝি হয় না রাজী
ষোল আনা নিয়ে পুঁজি, পাড়ের ঘাটে না গেলে
একবার তারে নিয়ে ওপাড়, আবার তারে আনে এপাড়
আসা-যাওয়া করিবে সার, বদ্ধ রয় মায়াজালে ॥

বাউল কবি কাঙ্গাল জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামীর গানের মর্মকথা আমাদের উপলব্ধির পাতায় নাড়া দেয়। জাগিয়ে তোলে ঘুমন্ত সত্ত্বাকে। প্রাথমিক শিক্ষা অনুত্তীর্ণ বাউল কবি তার গানের কথায় গভীর থেকে সুগভীরের আধ্যাত্মিকতা সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না