আলমগীর খান : অধিকার বঞ্চিত মানুষের কবি

আলাউল হোসেন

ব্যক্তি হৃদয়ের গোপন-গহন অতল-গহবর থেকে উৎসারিত অনুভূতির বাক্সময় প্রকাশই কবিতা। এ সৃষ্টি প্রক্রিয়াতে সমাজের সক্রিয় ভূমিকা থাকতেও পারে, আবার সমাজ বিচ্ছিন্ন সৃষ্টিও হয়তবা সম্ভব। কোলরিজ মনে করতেন, কবি প্রকৃতির বিশালতায় আবিষ্ট হয়ে থাকেন। কবির কল্পনা যেন ঈশ্বরের প্রতিধ্বনি; কবি কল্পনাকে পুনঃনির্মাণ করেন নিজের মত করে। কোলরিজ বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি হচ্ছে ঈশ্বরের শিল্প, কেননা পবিত্র কল্পনাশক্তি প্রকৃতিতে মিশে আছে। আর কবি তার কল্পনাশক্তি দিয়ে এই প্রকৃতির প্রতিরূপ নির্মাণ করেন তার চেতনার রঙে। তবে কবি বা শিল্পীরা প্রকৃতির অনুলিপি তৈরি করেন না কোন মতেই, যেটুকু অনুলিপি করেন তা রঙে ও বিভাসে- যা সমগ্র অর্থেই সুন্দর।

সমাজের অধিবাসী একজন কবি এবং তার সত্তা সমাজ দ্বারা প্রভাবিতও বটে। কবি আলমগীর খানের বেলায়ও তাই ঘটেছে। নিজেকে নিষ্কাশিত করে করে ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক চেতনায় স্থিত হতে তার সচেতন মন ও সজাগ দৃষ্টি কতখানি ব্যক্তি সর্বস্বতার উর্ধ্বে উঠতে পেরেছে, তা আমরা পরিমাপ করবো তার কবিতা দিয়ে।

আলমগীর খানের জন্ম ১৯৬৭ সালের ২৭ জুলাই পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার খানপুরা গ্রামে। লেখাপড়া শেষ করেন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জগন্নাথ কলেজ থেকে। তার কবিতা ও প্রবন্ধ বিভিন্ন দৈনিক ও সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি বেশ কিছু বিদেশি গল্প ও প্রবন্ধও অনুবাদ করেছেন। মার্ক টোয়েনের ‘ওয়ার প্রেয়ার’ গল্প অবলম্বনে লেখা তার ‘যুদ্ধের প্রার্থনা’ নাটকটি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ‘নতুন দিগন্ত’ (অক্টো-ডিসে ২০১০) জার্নালে প্রকাশিত হয়। বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে লেখা তার ‘আমরা করবো জয়’ নাটকটি ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও থিয়েটারে ও ছায়ানট ভবনে মঞ্চস্থ হয়েছে।

তিনি কিছুদিন একটি ইংরেজি পাক্ষিক বাংলাদেশ রিপোর্ট পত্রিকায় ডেপুটি এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় গবেষণা ও প্রকাশনার দায়িত্বে রয়েছেন। সংস্থার শিক্ষা বিষয়ক বুলেটিন শিক্ষালোকের তিনি নির্বাহী সম্পাদক। এছাড়াও তিনি নিয়মিত ঢাকা কুরিয়ার, ডেইলি স্টার, ডেইলি অবজারভার, দৈনিক ভোরের কাগজ, সংবাদ ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে লিখে থাকেন।

প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও লেখক আশরাফ আহমেদ তার কবিতা পড়ে মন্তব্য করেন, ‘কবিতাগুলো বারবার আমাকে এক মধ্যাাকর্ষণহীন শূন্যতায় নিয়ে গেছে এবং আনন্দ দিয়েছে। উত্তর কোনদিন মিলবে না জেনেও এগুলো আরও পড়বো যতবার প্রশ্নগুলো মনে আসবে।’

আলমগীর খানের কবিতা এরকমই। তিনি নিজেই বলেন-
কবিতা ঝড়ের মত। কখনো কখনো ঝড় খুব প্রয়োজন হয়
তখন কবিতা আসে। বহুদিন ধরে পৃথিবীতে
জঞ্জাল জমতে জমতে পাহাড় হলে
খানিক এলো হাওয়া ওঠে, প্রয়োজনে।
তখন বাতাসে কারো দূতাবাস ওড়ে
কারো বা নিশান পুড়ে ছাই হয় নীলিমায়।
(গদ্যের শৃঙ্খলে কবিতার নৈরাজ্য দমন)

আলমগীর খান মনে করেন দায়বদ্ধতা বা কমিটমেন্ট কবিতার নির্যাস। বাংলা কবিতায় দায়বোধ প্রতিফলিত হতে শুরু করে চল্লিশের দশকে। মার্কসীয বীক্ষার তখন তুমুল প্রভাব বিশ্বময়, পরপর দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতার জন্য বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, তদুপরি বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা আধুনিকতা- সবকিছু মিলিয়ে একটা সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে সময় কাটিয়েছেন কবিরা। অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য তাদের ভেতরে একটা বোধের জন্ম হয়। সেই বোধটাই দায়ের বোধ। তখনকার প্রধান কবিগণ মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, সময়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য কবিতা লিখে গেছেন।

নব্বই দশকের কবি আলমগীর খানকেও আমরা সেই পথেই হাঁটতে দেখছি। দায়পূরণের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রজদের পথেই হাঁটছেন। সংখ্যায় অল্প বা পরোক্ষভাবে যেভাবেই হোক, কমিটমেন্ট তার বোধে বোধে-
এখনো বন্দুক কাঁধে কোনো এক কালপুরুষ
ভবিষ্যতের স্বপ্ন চোখে জড়িয়ে জ্যোৎস্নার শরীরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায়।
সুদূর কাল অবধি তার নিদ্রাহীন পরিক্রমণ
পৃথিবীর সর্বত্র মানবমুক্তির চূড়ান্ত বিজয় কেতন উড়িয়ে দেবার জন্যে।
(কালপুরুষ)

একজন কবির কলমের আঁচড়ে সমাজের আমূল পরিবর্তন সম্ভবত এভাবেই ঘটতে পারে-
অনন্তের মহাদেশ থেকে ডাক আসে
মুক্তির বেহাগ বাজিয়ে ঝরাপাতার মতো উড়েউড়ে
অর্ফিয়ুসের অনিন্দ্য সুরে অথচ মানুষ এখনও
শ্রবণেন্দ্রিয়ে নিম্নরুচির গালা এঁটে
ভাগাড়ের দিকে মুখ করে বসে আছে
অপেক্ষার মুদ্রা চতুর্দিকে ইচ্ছেমতো উড়িয়ে হাজার বাহানায়।
(প্রেরিত পুরুষ)

হুমায়ুন আজাদ একটি গদ্যে লিখেছিলেন, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।’ আলমগীর খানও তাই বলেছেন। মানুষের মন, নারীর সম্ভ্রম, ছাত্রের মগজ, সম্পাদকের কলম, ব্যালট বাক্স, শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষকের কুঁড়েঘর, মাটির প্রদীপ, সিনেমা হল, ফেরিঘাট, সেতু, রেলওয়ে জংশন, কিশোরীর বেণী, রাজনীতির মঞ্চ, ব্যবসা, মন্দির, পরীক্ষা, পাটের কল, শিশুর শরীর, আর বিকেলের রোদ- সব কিছুই নষ্টদের অধিকারে যাচ্ছে বা যাবে। তবে-
শুধু কারো কারো কষ্ট কখনও
নষ্টদের অধিকারে যাবে না।
যতই ছুরির ফলা উড়ুক ফণার মতোন ভরদুপুরে
অমৃত পান করে বারান্দায় ঘুমাক শিশু নীলকণ্ঠ
প্রতিবাদী বুকের গভীর কষ্ট কোনোদিন
নষ্টদের অধিকারে যাবে না।
(যা নষ্টদের অধিকারে যাবে না)

বুননকে শিল্পীর চোখে দেখে নিবিষ্ট হওয়া যায়, কবির সেলাইর মহোৎসব সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। উচ্চ শ্রেণি নিম্ন শ্রেণিকে লালসার চোখে দেখে। গার্মেন্ট শিল্প শ্রমিককে সবকিছু এড়িয়ে চলমান ধারায় যে চলতে হয় তা আলমগীর খান তার কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন-
মাঝে মাঝে সেলাই হইও
ম্যানেজারের চোখে সেলাই
পুলিশের দণ্ডে সেলাই
সোনার মাংসপিণ্ডে সেলাই
লাঠিচার্জে ধর্মঘটে সেলাই হই।
(সেলাই)

মন রূপকথা খুঁজে বেড়ায় সবখানে; বিজ্ঞাপনের জগতে আমরা বুঁদ হয়ে যাই একটু সুখের আশায়। হোক সেটা বিলবোর্ড বা প্রিন্ট মিডিয়ার বিজ্ঞাপন। সব দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও আমরা মনের অতল গহীনে নির্দ্বিধায় আবিষ্কার করতে পারি বিজ্ঞাপন চিত্রের নায়িকাকে-
রোজ একখান নান রুটি খায়া দিন কাটাই
কোকাকোলা কি জুটবে রে কসিম্নকালেও?
তবু স্বপ্নে ভাবি, বিজ্ঞাপনের পক্ষীরে-
আমরা দুজন সমান হতে পারি কি ভুলেও
এখানে নয় হয়তো অন্যদিন অন্যখানে
এ্যাক রূপকথার দ্যাশে।
(রূপকথার দ্যাশে)

একজন শিল্পীর ভাললাগা আর ভালবাসা যে বিরাজ করে সবখানেই সেটা আলমগীর খানের দুটি পংক্তিতেই স্পষ্ট হয়ে উঠে-
কেউ কেউ হাজার বছর চেয়ে থেকেও দেখেনি
তারা না দেখার তৃষ্ণা নিয়ে মরে গেছে।
(অচেনা বালিকা)

দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’-এর সাম্যবাদী চিন্তা আমাদেরকে অহরহই কষ্টের অনুতাপ নিয়ে বাঁচতে শেখায়। তার মত করে ভাবনা ভাবতে গিয়ে আলমগীর খানও যেন আরেক ভাবনায় পড়ে যান-
জন্মই আমার আজন্ম পাপ
তোমার ইস্কাপনের টিক্কা
আমার পান্তায় নুনের অভাব আর
মাথার উপর সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল
দেখে প্রাসাদ-প্রেমিকারা হাসে
ইয়ে বের করে আমাদের ভেংচি কাটে
(জন্মেই তোমার ইস্কাপনের টিক্কা)

‘কপালে লাল টিপ পরনে ঢাকাই শাড়ি’ আহ্! রবীন্দ্রনাথের প্রেম কতটাই না মুখর ছিল। প্রেমিক চেয়ে চেয়ে সব পাওয়া না পাওয়ার মাঝেও যেন খুঁজে পায় প্রেমের মুগ্ধতা, অপেক্ষাতেও যেন তার সুখের শেষ নেই-
না কিছু ভাবো, না কিছু বোঝো
তোমার চুল যে আমার বুকে তুলেছে ঝড়
তোমারই জন্য হে মেয়ে
আমি অপেক্ষা করেছি শত শত বছর।
(ঢাকাই শাড়িতে ঢাকোনি শরীর)

আলমগীর খানের কবিতা প্রাণের প্রবহমানতার প্রতিবেদন। পড়তে গেলে এক ধরনের মুগ্ধতা ছড়ায় মনের কোণে; তবু স্নিগ্ধতার আবেশ খুঁজতে গিয়ে কী যেন না পাওয়ার বেদনাও বার বার উঁকি দেয়। সাম্যবাদী ভাবনা ভাবতে গিয়ে কবি যেন গণতন্ত্রকে হারিয়ে ফেলেছেন তার কবিতায়। যদিও আমরা এ-ও জানি, ক্ষেত্র প্রস্তুত না হলে গণতন্ত্রের সোনালি ফসলে সমাজ সমৃদ্ধ হয় না। একজন কবি যখন তার দেশ এবং সমাজের নিজস্ব ভাবধারা ও চেতনা রক্তের স্পন্দনে অনুভব করেন, তখনই তার পক্ষে মহৎ কবিতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। এ জন্যে প্রথমেই তাকে যে সত্যটি উপলব্ধি করতে হয়, তা হলো- ব্যক্তিমনের চেয়ে দেশাশ্রিত মনকে বড় করে দেখা। সেই দিক থেকে আলমগীর খানের ভাবনা যথার্থ। তাছাড়া তিনি কবিতার শব্দচয়নে ও ছন্দ প্রয়োগেও যে সিদ্ধহস্ত সেটার প্রমাণ তিনি তার ‘যার যার বাঁশি ও বন্দুক’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে দিয়ে গেছেন।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না