খান নূরুজ্জামানের কবিতা : নন্দনের প্রকরণমালা

আলাউল হোসেন

একজন ব্যক্তি মানুষ যদি হাত বাড়িয়েই প্রত্যাশার আলোয় নিজেকে ধন্য করতে চায়, তাহলে বিপত্তি বাঁধে। কেননা হাত বাড়ালেই কাক্সিক্ষত বস্তু নাও মিলতে পারে। তখন ব্যক্তি মানুষ যদি প্রত্যাশার কোঠাকে প্রাপ্তির নিক্তিতে শূন্য ধরে নেয়, তাহলে সেটা কতটা যুক্তিময়? সব ঝিনুকই মুক্তা ফলাতে পারে না। আর মুক্তা পেতে হলে সামান্য অনুসন্ধানই যথেষ্ট নয়- এই দিকটি সামনে রেখেই কবি খান নূরুজ্জামান সন্ধান করছেন কবিতার অলিগলি। ‘খেয়া’ নামের একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলার সাঁথিয়ার পাটগাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

মহৎ উপলব্ধি, স্বাতন্ত্র্য বিষয়বস্তু, চিন্তার গভীরতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকজ অনুষঙ্গ, নিসর্গ নিবিড়তা, পুরাণ, চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি চেতনার উল্মফন, প্রবল দেশপ্রেম, স্বপ্ন, সংগ্রাম ও তার অন্তর্নিহিত বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনার যূথবদ্ধতায় সৃষ্টি খান নূরুজ্জামানের কবিতা। নিকট পরিবেশের নিবিড় প্রত্যয়ন, খাঁটি বাংলা ও গ্রামীণ অন্ত্যজ শব্দযোগে দর্শনঋদ্ধ শিকড়স্পর্শী প্রকৃষ্ট এক কাব্যাঞ্চল নির্মাণের ব্যতিক্রমী এ কবিতার কুশীলব বাংলা কবিতার সম্ভাবনাকেই করে তুলেছেন উজ্জ্বল ও প্রত্যয়দীপ্ত-
দোকানে দোকানে ভরে উঠছে মাটির বুক
আকাশ, জলের অতল
দোকান ডানে, দোকান বামে
সামনে, পিছনে দোকান।
শিশুর খেলার মাঠ; মোড়ে মোড়ে
বিজ্ঞাপনে বিবসনা হাসে
সেও তো দোকান!
দোকান সূত্রে তৈরি মানুষের বাসগৃহ
প্রার্থনাঘর, বিদ্যাবিতান
অবাক চেহারা তাদের দোকান সমান।
(দোকানসূত্র)

তার কবিতার দেহে বাংলার রূপ-রং-বর্ণ ও গন্ধের মৌলিক উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত তার মহত্তম উপলব্ধির প্রজ্ঞাপূর্ণ শৈল্পিকতায় কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে একটি ভাষা, জাতি ও দেশের আত্মপরিচয়, মানবিক মূল্যবোধ, স্বপ্নের বিশ্বস্ত দলিল। যার অন্তঃস্থল ঠিকরে পড়ে মহৎশিল্পের আলোকচ্ছটা যা বাংলা কবিতার মুখকে করে তোলে আলোকিত এবং প্রচণ্ডরূপে আশাবাদী। অভিনউপমা, চিত্রকল্প, দূরান্বয়ীপ্রতীক, বাক্যের দ্যোতনা, শব্দের ঝংকার, ছন্দ, দর্শনব্যঞ্জনার ললিল সম্মিলন তার প্রতিটি কবিতা-
আমারও দিন গ্যাছে শাপলা ফোটা বিলে।
আউশের গন্ধে ডুবে কিশোরবেলা।
শ্যাওলার গায়ে টোকা দিয়ে
কাতল নেড়ে গ্যাছে আমনের ছোপ।
(দোতারা হাতে)

বাংলা কবিতার গীতলময় ঐতিহ্য সারাৎসার নিঃসৃত ভিন্ন সুর ও স্বরের সুষমা এই কবির কবিতা বিশুদ্ধ কবিতার স্বপক্ষেই অবস্থানকে স্পষ্ট করেছেন। নান্দনিক উপলব্ধি ও অনুভবের ব্যঞ্জনায় শব্দের পর শব্দ জুড়ে নতুন শব্দ তৈরিতে পারদর্শীতা, ছন্দের প্রবহমানতা, স্বযতেœ উপনিবেশিক শব্দ পরিহারের প্রচেষ্টা, পরিচিত পরিবেশ থেকে উপকরণ সংগ্রহ, আধুনিক মানসিকতা, আত্মঅনুসন্ধান দিয়ে কবিতার বাঁককে ঘুরিয়ে তিনি করে দেন মৃত্তিকালগ্ন বাঙালি হৃদয় তথা বাংলা ভাষার দখিনদুয়ারী বাতায়ন বরাবর যেখানে শিল্পের হাওয়া কেবল প্রবাহিত হয় শিকড়ের জল, পলি, নবান্নের গন্ধ মেখে। এখানেই খান নূরুজ্জামান মৌলিক ও অপরিহার্য। তার কবিতায় দীর্ঘ পরিভ্রমণ ক্লান্তিহীনভাবে আশ্চর্য নির্মাণের স্মারক হয়ে অভিভুত করে বোদ্ধা পাঠককে। আত্মঅনুসন্ধানের আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন বাংলা ভাষাভাষী শস্যগন্ধী ভূগোলের মুগ্ধ নীলিমায়-
এই ধুপকাঠি নেভার পর আরো ধুপ জ্বলবে।
ধুপের ধোঁয়ায় ক্রমান্বয়ে বড় হবে অন্ধত্বের পরিধি।
বিশ্বাসের আফিম ছড়িয়ে কুমির পেরিয়ে যাবে ডাঙার সীমা।
এ সুযোগে পুষ্টির ভাগ যাবে সেবকের পেটে।
সেবক- লুটেরার প্রতারক ফাঁদ।
মানুষ- দৌড়ে যাচ্ছে পিছনের দিকে।
পিছন- সরে যাচ্ছে কৃষ্ণবিবরে।
ধুপ, আফিম, অন্ধত্ব মিলে তৈরি দুঃখের বর্গক্ষেত্র।
যা আঁকা আছে আজন্ম আমাদের কপালের ভাঁজে।
এবং আমি সেই পবিত্র মায়ের গল্প বলছি- যে কোনদিন তার সন্তানের ছিলো না।
(মাভূমি)

জল, কাদামাটি ছেনে এই কবির যে উচ্চারণ তা বাঙালির সহজাত ও আধুনিক গীতিপ্রবণ কবিতার গতিশীল মেজাজ ধারণ করে। এই তরুণের কবিতায় নিজস্ব একটা স্রোত উচ্ছ্বাস আছে দৃশ্যের সে দৃশ্যের সংযোগে যা গভীর বার্তাবাহী ফলে পাঠকের হৃদয়ে তা সৃষ্টি করে তীব্র অনুরণন আর এটাই তার কবিতার শক্তি ও সনাক্তযোগ্য চি‎ । যথোপযোগী শব্দের শৃংখলিত বিন্যাসের সৌন্দর্যে লীলায়িত এই কবির কাব্যশরীর। তার কবিতার বৈশিষ্ট্য প্রকৃতির ভিতরে প্রাণ সঞ্চারণ ও গ্রামীণ আবহে ছড়ানো ছিটানো সকল দৃশ্যাবলীর ভিন্ন এক উপস্থাপন যা একজন মৌলিক বা প্রকৃত কবির দৃষ্টিতেই ধরা দেয়। একটি দেশ, জাতির সামগ্রিক ও চিরন্তন সম্ভাবনাকে পরম মমতায় সৌন্দর্যের তুলিতে এঁকেছেন কবি-
আমার গানে সুর দেয় মাঠের সবুজ
নিসর্গের কণ্ঠ ছুঁয়ে মেলোডির তার
শিকড়ের দিকে রাখা নির্ঘুম দোতারা
প্রাণের বিপুলে প্রাকৃত শস্যের খামার।
(প্রাকৃত শস্যের খামার)

অসাধারণ চিত্রকল্প, দার্শনিক জিজ্ঞাসা, নন্দনতত্ত্ব তার কবিতায় ব্যাকরণ সূত্র হয়ে বার বার ফিরে এসেছে। জীবনের দরোজা পার হবার জন্য যেন তার এভাবেই পথ চলা। পাঠক মুগ্ধ হয় তার বুনোহাঁস শিকারের মত তার শব্দ শিকার দেখে। নন্দনের ডালে ফুটে ওঠে তার অজস্র কর্দম ক্লেদজ ফুল-
এ ধুলোপথে নিবেদিত ইতিহাসের চাবি; গন্তব্যের শ্রাবণ
অবুঝ বনিকের ক্লাউন- থামাও তোমার জুতোর শব্দ।
দ্যাখো- পাখি উড়ছে পালকের পাপ; সৌন্দর্যের দায় ঠোঁটে।

আমার কৃষকপিতার নিবির চর্চায় মাঠ-ফসলের গেরিলা
তাঁর লাঙল রোদকথায় পূর্ণ; যেমন কেটলির ভেতর
জেমসের ট্রেন।
তুমি জানো না অন্ধ- আমি সেই বৃক্ষের বীজ যার
পূর্বপুরুষ স্বপ্নের বদলে ফেলে এসেছে পাঁজরের হাড়
কামারশালার আগুনে।
উঁল্কির বদলে বাহুতে এঁকেছে আজন্ম বাঙলাদেশ।

আর আমি তাঁর একমাত্র মেঘ ও বজ্রে গড়া উত্তরআকাশ।
(উত্তরাধিকার)

প্রকৃত কবিতা সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষকে উপেক্ষা করে রচিত নয়, মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে যে কবিতায় উপেক্ষিত, সে কবিতা সাময়িক মনোরঞ্জনের উপাচার হয় মাত্র; চিরকালের মন জাগাতে পারে না। মন জোগাতে পারলেই সে কবিতার উদ্দেশ্য শেষ, চিরকালের পাঠ্য হওয়ার কোনও গুঢ়ার্থ সেখানে থাকে না। কবি খান নূরুজ্জামান সামাজিক, তাই সমাজের ভালো-মন্দে তার ভেতরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রাত্যহিক ঘটনাবলীও তার চিন্তার বিষয়-
দুধেভাতে উৎপাত ভেবে যারা বা’হাতে তাড়াচ্ছো মাছি তাদের কবরও সারে তিন হাত;
চিতাতে সমান আগুন। অতএব; বাইরে তাকাও, দ্যাখো- জীবনসংহার উপরে দিচ্ছে
চৈত্রের দগ্ধমুখ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সকল গ্রাম ছেঁয়ে গ্যালো দুঃখের ঝোঁপঝাড় লতাগুল্মে।
(ভাতের সামান্য উচ্চতার কাছে)

খান নূরুজ্জামানের তাবৎ কবিতা জুড়ে রয়েছে শরীরের ধ্বনি ব্যঞ্জনায় খণ্ড খণ্ড জিজ্ঞাসার মালা। এই জিজ্ঞাসার গুপ্ত রসায়ন তাকে পৌঁছে দেয় কবিতার অধিজগতে। ফলে তার কবিতাগুলি সহজভাবে উপস্থাপিত হলেও এক পর্যায়ে বোধের কাছে ধোয়াটে হয়ে ওঠে। সংগত শব্দ ব্যবহারে তার অনাগ্রহতাকে ভিন্ন আর দূরহ করে তোলে কিন্তু তার কবিতা শেষ পর্যন্ত দুর্বোধ্য নয়। কবিতার ধ্বনিমালার এই দাহ খান নূরুজ্জামানকে আলাদা করে দেয়।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না