নুরুল ইসলাম বাবুল : অন্ধকারে আলোকবর্তিকার কবি

আলাউল হোসেন

কবির আন্তরিক আর স্বতঃস্ফুর্ত উচ্চারণই যথার্থ কবিতা। কবি মাত্রই সত্য আর সুন্দরের পূজারী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কবিতায় আমি কখনো মিথ্যে বলি না।’ আর আব্দুুল মান্নান সরকার বিশ^কবির কথার রেশ টেনে বলেছেন, ‘কবিতায় মিথ্যে বলা যায় না, কেননা কবিকে যে উঁচুতে উঠে উচ্চারণ করতে হয়, সেখানে আর সত্য মিথ্যে বলেই কিছু থাকে না।’ কবি নুরুল ইসলাম বাবুল সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দেওয়ার আগে জানাতে চাই কবিতা নিয়ে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির কথা। গত ১৪ জুলাই ২০১৭ দৈনিক জনকন্ঠের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় নুরুল ইসলাম বাবুলের পাঁচটি কবিতাসহ সাহিত্য ভাবনা। সেখানে ‘কবিতার প্রতিটি শব্দ সত্য আর সুন্দর’ শিরোনামে বাবুল লিখেছেন, ‘সেই কবে যেন কবিতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। হতে পারে কিশোর বেলায়। তখন বুঝে অথবা না বুঝেই বারবার কবিতা পড়েছি। তারপর মুগ্ধ হতে হতে কবিতার ভেতরে পেয়েছি জীবনের পরম আস্বাদ। কবিতা আমাকে ঋদ্ধ করেছে, শুদ্ধ করেছে; করেছে খানিকটা অহংকারী। বোধের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় যে কবিতার প্রতিটি শব্দ, ইচ্ছে করলেই সেই কবিতা ধরা যায় না, নির্মাণ করা যায় না। আমি যখন কবিতা লিখতে চেয়েছি, পারি নাই। যখন ঠিক লিখে ফেলেছি, অনায়সে তা পেরেছি। কেমন করে পঙ্ক্তিগুলো এসেছে আমি তা জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। আমার মনে হয় কে যেন আমাকে দিয়ে কথাগুলো লিখে দিয়ে যায়। আর যখন লেখা হয়ে যায় তার পরের মুহূর্তগুলো কেটে যায় মায়াবী ঘোরের ভেতর। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। কেমন- কেমন তা বলতে পারব না। শুধু আমি যেন আনন্দ আর উত্তেজনায় বিভোর হয়ে থাকি। আর বারবার আওড়াতে ইচ্ছে করে সদ্য প্রসূত বাক্যগুলো। যদি একটা চরম সত্য কথা বলা যায়, তবে অনায়সে বলতে পারি, কবিতা যাকে স্পর্শ করেছে আলিঙ্গনে-আলিঙ্গনে মধুর করে তুলেছে তার জীবন। কবিতার ভেতরে যে ডুব দিয়েছে কোন মিথ্যাই তাকে আসক্ত করতে পারে নাই। কেননা, কবিতার প্রতিটি শব্দ অমোঘ সত্য আর সুন্দর।’

কবি নুরুল ইসলাম বাবুলের জন্ম ১৯৭৯ সালের ৫ মে পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার পাথার অঞ্চলের বিলচান্দক গ্রামে। পিতা আব্দুল করিম সরকার ও মাতা সুফিয়া খাতুনের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি বড় সন্তান। লেখাপড়া শেষ করেন বাংলা সাহিত্য নিয়ে বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজ থেকে। বর্তমানে বিলচান্দক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি লেখালেখি শুরু করেন কবিতা দিয়েই। শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত হয়ে কোমলমতি শিশুদের চঞ্চলতা, হাসি-কান্নাসহ দৈনন্দিন কিছু ঘটনা তাঁকে আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে। তখন তিনি মনে-প্রাণে হয়ে ওঠেন শিশুসাহিত্যক। ছোটদের জন্য ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেছেন শিশু, নবারুণ, ধানশালিকের দেশসহ বিভিন্ন শিশুতোষ সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায়। এ পর্যন্ত প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থ সাতটি। এছাড়াও শিশু-কিশোর সাহিত্য পত্রিকা ‘হইচই’ এবং লেখালেখির কাগজ ‘পাথার’ সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। লিখেছেন ভ্রমণকাহিনী ‘দক্ষিণ বাংলার পথে পথে’ যা দৈনিক জনকন্ঠের ভ্রমণ পাতায় এগারোটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কবিতা যার আরাধ্য সাধনার বিষয়, কবিতার সাথে যার অন্তরের গভীর যোগাযোগ তিনি তো বারবার কবিতার কাছেই ফিরে আসবেন, কবিতা নির্মাণ করবেন। কবি নুরুল ইসলাম বাবুলের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আমার প্রথম’ (২০০৩) পাঠে কবির চিন্তা ও চেতনার দিকটি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। এছাড়াও তাঁর এই সময়ে দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতায়, বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কবিতাগুলো এবং প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ ‘সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়’ পাণ্ডুলিপি পাঠ করে মুগ্ধ হতে হয়। যোগায় নতুন চিন্তার খোরাক।

কবির দৃষ্টি তীব্র আর তীক্ষ্ম। সেই দৃষ্টিতেই নুরুল ইসলাম বাবুল জীবনের অলি-গলিতে দেখতে পেয়েছেন এক জটিল-কঠিন অন্ধকার। যাকে তিনি বলেছেন ‘অপাঙক্তেয় আঁধার’। যে আঁধার ছেঁয়ে আছে প্রতিটি মানুষের জীবনে। আর সময়ে-অসময়ে তা বিপন্ন করে তুলছে জীবনের স্বাভাবিক গতি। স্বপ্নচারী মানুষ তাই স্বপ্নভঙ্গের মুখোমুখি হচ্ছে। কবির উচ্চারণ-
তবুও বিপ্রতীপ স্বপ্নের বৃত্তে বারবার
পরিবৃত হয় জীবনের গতি,
চারপাশে ফোঁস-ফোঁস ফণি নিঃশ্বাস;
আহা! জীবনে কে চায় ধ্বংস প্লাবন
স্বপ্ন যেখানে বহতা নদীর মতো।
(শিল্পী মানস অথবা স্বাপ্নিক জীবনের বৃত্তান্ত/আমার প্রথম)

কিন্তু কেন বহতা নদীর মতো জীবনে বারবার পরাজিত হবে স্বপ্ন। হোঁচট খাবে অনেক দূরের দৃষ্টি। রক্তাক্ত হয়ে পড়বে একেকটি পবিত্র হৃদয়। যা কবিকে শুধু নয়, আমাদের আহত করে, ব্যথিত করে তোলে। এ বিষয়ে কবির চিন্তার সাথে আমাদের সহমত ঘটে যায়। কেননা, জগতের সব অন্ধকার শুধু জাগতিক নিয়মেই ঘটে না, ভুল মানুষের ইতরপনায়ও নষ্ট হয় আলোকিত সুন্দর। শুদ্ধ বিবেক বিসর্জিত হয় বলেই কলুষিত হচ্ছে সমাজ, দেশ, পৃথিবী। কবির কবিতায়-
বোধের চৌকাঠে ফাঁদ পেতে আছে
শ্বাপদ সময়;
নীলকণ্ঠী মানবতা দ্যাখে
চারপাশে বিবেকের নষ্ট ভাঙন।
(শ্বাপদ সময়/ আমার প্রথম)

এই যে নষ্ট ভাঙন। এই যে অসুন্দরের কাছে আত্মসমর্পন। এ থেকে কি মুক্তি নাই? বের হওয়ার পথ নাই? আছে। কিন্তু তা সহজ নয়। অনন্তকাল ধরে ক্ষয়ে যাওয়া বোধ, অশুদ্ধি আত্মার সাথে বসবাস; হঠাৎ করেই তা ঘুচানো যায় না। এজন্য তৈরি হতে হয়, তৈরি করতে হয়। নুরুল ইসলাম বাবুল সেই অনভিজ্ঞ কর্মী। কবি বলেছেন-
আবারও গর্জে ওঠে প্রোথিত বিশ্বাসগুলো। এবং
প্রতিবাদী হয়ে যাই আমরা। আমাদের
পায়ের নীচে ছুঁইছুঁই দূর্বাঘাস অথবা ঘাসফুল।
আমরা কজন আনাড়ি জোয়ান শান দেই বোধে-প্রত্যয়ে।
(পুনশ্চ মহড়া/আমার প্রথম)

কবি নুরুল ইসলাম বাবুল মানুষের মন ও মননে, চিন্তা ও চেতনার জগতে যেমন ঢুকতে চেয়েছেন, তেমনি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন মানব হৃদয়ের বিকশিত হয়ে ওঠার আকুতি। পরিশুদ্ধ হৃদয় মাত্রই হয়ে উঠতে চায় ফলবতী বৃক্ষ, যা জীবনকে সার্থক আর সুন্দর করে। কবির ভাষায়-
কিছু প্রার্থনা নিবিড়তা খোঁজে; জলের নিয়মে চায় মাটির সখ্যতা। আমরা
তো জানি কতটা আদ্রতায় অঙ্কুরোদগম হয় রোপিত বীজ।… তবু
প্রতীক্ষা কতক্ষণ দীর্ঘ হলে প্রার্থনার সময় সঠিক হবে জল ও মাটির গুণন।
কেননা আমাদের হৃদয় আজ বৃক্ষ হতে চায় অঙ্কুরোদগমের চিরায়ত কানুনে।’
(বৃক্ষ জার্নাল/সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়)

প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবন গেঁথে আছে নিবিড়ভাবে। প্রকৃতির ঋতু বদলে যেমন পাল্টে যায় পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানুষের জীবনেও রয়েছে নানা রকম উত্থান-পতন। রয়েছে ভাঙা-গড়া। বসন্ত বাতাসে যেমন মানুষের মনে জাগতে পারে নব প্রেমের দোলা, বৈশাখি তাণ্ডবে তেমনি এলোমেলো হয়ে যেতে পারে সাজানো জীবন। কবির ভাষায়-
অতঃপর টিকে যাওয়া জীবনের এই প্রেম
ঋতুচক্রে আবর্তিত এই খেলাঘর
বৈশাখ করে দেয় কিছু এলোমেলো
মৃদু হয় কোকিলের স্বর।
(বৈশাখের পদাবলী/সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়)

নুরুল ইসলাম বাবুল তাঁর কোনো-কোনো কবিতায় মহাজীবন প্রবাহের সাথে বিশ্ব-ব্রম্মাণ্ডের বাস্তব আর পরাবাস্তব রস সংযোগ ঘটিয়ে চমৎকার এক চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। তেমনি একটি কবিতা-
ঘুমের গন্ধ পেয়ে রাতের শয্যায় শোয় ক্লান্ত বিকেল
বংশপরম্পরায় এই রাত এই বিকেল এই ঘুম
চষে বেড়ায় নক্ষত্রের আলো-
নিরবতা… শুন্যতা…স্তব্ধতার আস্বাদ;

তবু কিছু স্বপ্ন জমে থাকে অতিক্রান্ত সময়ের কাছে
কিছু প্রেম বিকশিত হতে হতে কিশোরীর চুরি ভাঙ্গে
এবং ভাঙ্গার শব্দে হেসে লুটোপুটি খায় লতাপাতাঘাস।’
(বিছানার কলঙ্ক/সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়)

অন্য একটি কবিতায় কবি তুলে ধরেছেন মানুষের সবচেয়ে আদিমতম ইতিহাস। আর তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন বংশ পরম্পরায় আমরা একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছি। কবি নিজেও এই পথের ভিন্ন পথিক নয়। তাঁর ভাষায়-
বাতাসে উড়িয়ে চুল হেঁটে যায় আদিমাতা
আমি তাঁর চুলের গন্ধ শুঁকে-শুঁকে
খেয়ে ফেলি নিষিদ্ধ গন্ধম…’
(হেঁটে যায় আদিমাতা/সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়)

আমরা তো নয়-ই কবি নিজেও যখন এ কথা বলেন কবিতার শেষ পঙ্ক্তিতে তখন আর উপায় কি আমাদের-
এ মনে লাগে উদাসী হাওয়া
তবু পেরুতে পারি না সংসারের চৌকাঠ
ডিঙানো হয় না সামাজিক প্রথা;’

আমরা তো সাধারণ। আমরা তো সহজেই পাঠ করতে পারি না কবির অন্তরের গভীরতর বেদনা। কবিকে আবিষ্কার করা যে সহজ নয়। তা করতে হলে ডুবতে হয়, ডুবে যেতে হয় কবির সৃষ্টিকর্মের অতল সমুদ্রে। ডুবতে-ডুবতে একটু হলেও চেনা যেতে পারে কবির অন্তহীন দুঃখের কিছু অংশ। কবি নুরুল ইসলাম বাবুল লিখেছেন-
হঠাৎ চিনে ফেললে কবির দুঃখ
ফালাফালা হয়ে যায় আলো-ছায়া রোদ-বৃষ্টি
ছুটোছুটি করে পালিয়ে যায় কিছু আয়ূ
কবির দুঃস্বপ্নের মতো…’
(অংশীদার/সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়)

নুরুল ইসলাম বাবুল মনে করেন প্রতিটি মানুষ ভেতরে-ভেতরে বড় বেশি নিঃসঙ্গ, খুব বেশি একা। নিজের ভেতরের নিরন্তর দহন নিজেকেই পোড়ায়, অন্য কেউ তার অংশীদার হতে পারে না। কেননা এ আগুন তার একান্তই নিজস্ব। কবিও এই অন্তর্জ্বালা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই তিনি উচ্চারণ করেন-
এইভাবে কেটে যাচ্ছে দিন
নিজের আগুনে পুড়ে-পুড়ে।
(নিজের আগুনে/সবকিছ মিথ্যা হয়ে যায়)

আমরা দেখেছি কবি নুরুল ইসলাম বাবুলের বেশ কিছ কবিতায় সত্য ও মিথ্যা, সুন্দর ও অসুন্দর, আগুন ও আঁধার, বিশ^াস ও অবিশ^াস নানাভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। কবিতাগুলো গভীর মনোযোগসহ পাঠ করলে জানা যায় আসলে কী বলতে চান কবি। কী বলতে চান সে কথা জানার আগে আমরা পড়ি কবির আরও একটি চমৎকার কবিতা-
চেনা মুখগুলো কী সুন্দর বদলে যায়
আধাঁরের আড়ালে…
এক অলিখিত লিয়াঁজোর চক্রান্তে
লুট হয় আমাদের প্রিয় নদী
ক্ষত ও খুনের স্বাক্ষী থাকে অগণন মরা মাছ;
বিশ্বাসী চোখগুলো কেবল সূর্যের সমর্থন চায়।’
(বিশ^াসী চোখগুলো/সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়)

আসলে কী মিথ্যা হয়ে যায়। কেন মিথ্যা হয়ে যায়। কবি নুরুল ইসলাম বাবুল সে কথাই জানাতে চায় তার প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ ‘সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়’র কবিতার মধ্য দিয়ে। নিরাশার ভেতর দিয়ে কবি খোঁজেন আশার আলো। হিংসা-দ্বেষ, লোভ ও লাভের হিসেব চিরকাল ধরে রাখা যায় না। জীবনের প্রচণ্ড প্রতাপও একদিন ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু এই যে বেঁচে থাকা, এই যে মহাজীবন প্রবাহ, এর ভেতরের অপাঙক্তেয় আঁধার থেকে কবি মুক্তি চান, সবাইকে মুক্ত দেখতে চান। অন্ধকারে জ্বালাতে চান আলো। তাই তিনি তাবৎ অন্ধকারেও আলোকবর্তিকার কবি।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না