আলাউল হোসেন
শাশ্বত কালের অব্যক্ত কথামালার প্রকাশের মধুর প্রকাশ হলো কবিতা। সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা কবিতা। কবির সাথে কবিতার সম্পর্ক হৃদয়ের স্পন্দনের মত। স্পন্দন থেমে গেলে ব্যক্তি-হৃদয় অচল হয়। মৃত্যু হয় কবির। কবিতা বিহীন কবি অচচব্যক্তি হৃদয়ের গোপন-গহন, অতল-গহবর থেকে উচ্ছিত অনুভূতির বাক্সময় প্রকাশই কবিতা। এ সৃষ্টি প্রক্রিয়াতে সমাজের সক্রিয় ভূমিকা থাকতেও পারে, আবার সমাজ বিচ্ছিন্ন সৃষ্টিও হয়তবা সম্ভব। কোলরিজ মনে করতেন, কবি প্রকৃতির বিশালতায় আবিষ্ট হয়ে থাকেন। কবিতা বলতে বুঝায় যাদুময় বক্তব্য এবং প্রথগত মন্ত্রোচ্চারণ তা অতি উচ্চ কালিক বিতার বিবর্তনে ছন্দময়। সেটা ছিল প্রাচীন গোত্র সমাজের আনুষ্ঠানিক গল্প বলার মত। কবিতা তৈরি হয় সহানুভূতির যাদু দ্বারা যেখানে তার কাক্সিক্ষত ঘটনাবলীর একটা তালিকা থাকে যা পরে বিস্তার লাভ করে।
অলোক আচার্য্য একজন কবি। তার জন্ম ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার দক্ষিণপাড়া গ্রামে। সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ পাবনা থেকে ব্যাবস্থাপনা বিভাগে ২০০৫ সালে পড়াশোনা শেষ করার পর ঢাকায় বেসরকারি চাকরি বেছে নেন। কিন্তু মন যার সৃষ্টির নেশায় ব্যস্ত তাকে কি নিয়মের বেড়াজালে আটকানো যায়। তাই বছর দুয়েক পরেই বাড়ি ফিরে আসেন। সেখানে স্থানীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন। সেই সাথে লেখালেখি শুরু করেন পুরোদমে। কারণ অলোক আচার্য্য তার শিক্ষা জীবন থেকেই বিভিন্ন দৈনিকে লেখালেখি করে আসছিলেন। প্রথম দিকে তিনি একজন ব্লগার হিসেবে প্রচুর লিখতে থাকেন। প্রথম আলো ব্লগ, জলছবি বাতায়ন, বন্ধু ব্লগ, বন্ধুসভা ব্লগসহ বিভিন্ন ব্লগে কবিতা, গল্প আর প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। সেখান থেকেই কবি শব্দটি তার নামের পাশে যোগ হয়ে যায়। প্রথম আলো ব্লগ থেকে নির্বাচিত লেখক কবির লেখা নিয়ে প্রকাশিত সংকলন ‘আলোর মিছিলে আমার যাপিত জীবন, জলছবি বাতায়ন থেকে দুটি সংকলনে বেশ কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। পাবনার স্থানীয় পত্রিকায়ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির ধারায় এখন কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিতভাবে কলাম লিখছেন। প্রতিদিনের সংবাদ, ভোরের ডাক, খোলা কাগজ, করতোয়া, আজকালের খবর, সংবাদ ও ডেসটিনিতে তার সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখা এখন নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে। সেই সাথে লিখছেন ছোটগল্প, শিশু কিশোরদের লেখা ও কবিতা। শিক্ষকতার পাশাপাশি এখন দৈনিক ইত্তেফাকের বেড়া উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
কবিতায় কী হয়? কবিতায় কখনও বেজেছে যুদ্ধের দামামা, কখনও প্রেমের জয়গান, কখনও মানবতার মুক্তি। কবিতা নিজেই একটি ভাষা, নিজেই একটি অস্ত্র। যুগে যুগে প্রবাহমান ভাবধারায় কবিতা তার স্বকীয় প্রবাহে বহমান। কবিতা সব থেকে বেশি টানে জীবনকে। জীবনের সাথে সম্পর্ক রেখে কবিতা আন্দোলিত হয়। কবির ভাষায়-
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামুক আজ
ধুয়ে যাক পৃথিবীর সব পাপ
মুছে যাক গ্লানির যত চহ্নি সব
হে কবিতা, আজ তুমি মুক্ত হও।
খুলে যাক আজ যত বন্দি খাাঁচা
গর্জে উঠুক জনতার কোলাহল
ঠোঁটে মেখে নাও যত নীলকণ্ঠ বিষ
হে কবিতা, আজ তুমি মুক্ত হও।
(হে কবিতা, আজ তুমি মুক্ত হও)
এক সময় কবি মানেই হত ধর্ম প্রচারক অথবা আধ্যাত্মিক পাগল। এখন কবির সে অবস্থা নেই। যদিও কবি তার আধ্যাত্মিক শক্তির বলে কাব্যে মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরতে পারেন, কিন্তু তারপরেও কবিতা এখন তার সহস্যময়তার চেয়ে গণমানুষের আলোচ্য এবং মূল্যায়নের বিষয় হয়ে গেছে। কবিতা নিজের হারানো অবস্থানকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় রত হলে এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের কাব্যের জন্ম হয়-
ভেবেছিলাম
আমার প্রেম নিয়ে এক কাব্য হবে
তারপর; কাব্য থেকে মহাকাব্য-
যেমন করে
বৃষ্টি গড়িয়ে নদী হয়
নদী গড়িয়ে সমুদ্র।
এরপর একদিন মিঠে জল
মিশে একাকার হয় লোনা জলের সাথে
দূরে থাকে অভাগা বৃষ্টি।
সবশেষে একদিন
দূরের বৃষ্টিও ধরা দেয় আমার কাছে।
আমি জানালার ধার ঘেঁষে দু’হাত বাড়িয়ে দেই-
জল গড়িয়ে আসে আমারই দু’হাতে।
(প্রেমকাব্য)
অলোক আচার্য্য তার কবিতায় গদ্যে-পদ্যে মাখামাখি তার কবিসত্তার সেই দিকটিকে উন্মোচিত করে দিয়েছেন যার মধ্য দিয়ে আমরা কাব্যস্বভাব বুঝতে পারি অনায়াসেই-
রেখেছি হাতের মুঠোয় অনন্তকালের স্বপ্ন
তুমি এসো, আমি তোমাকে স্বপ্ন দেখাবো।
সেখানে তুমি থাকবে, আমি থাকবো আর
জানালায় থাকবে এক টুকরো আকাশ।
(অপেক্ষা)
অলোক আচার্য্য তার কবিতায় মন ও হৃদয়ের সমন্বয় সাধন করতে চেয়েছেন। হৃদয় সর্বদাইমনকে বোকা বানায় আবার যারা মনের খবর রাখে তারা হৃদয়ের খবর রাখে না। এ রকম দোলাচলে কবি তার কাব্যভাবনায় নিমগ্ন। গ্রামীণ নিসর্গও তাকে টানে, নাগরিকতা তাকে ভাবায়; পথ-প্রকৃতি-সৌন্দর্যের গান তেমনিভাবেই বেঁজে চলে তার কবিতার পরতে পরতে-
পৃথিবী ঘুমায় যখন গোধূলির বুকে
আমার সারাবেলা কেটে যায়
বকের দল সার বেঁধে
উড়ে যায় পাখা ঝাঁপটায়
মেশে গিয়ে দিগন্তের বুকে।
পৃথিবীর বুক জুড়ে আঁধারের কোলাহল
ঘিরে আসে চারিদিক
খোলা ঢেউ পাল তোলা নৌকার পাটাতন
কাটে কিছুক্ষণ মেঘবালিকার সাথে।
(পৃথিবী ঘুমায় যখন)
অলোক আচার্যেও কাছে কবিতা এবং প্রেম কখনও একসূত্রে গাঁথা। প্রেম কখনও হারেনি কবিতার কাছে। যুগে যুগে তাই কবিতার প্রতিটি কাব্য ভাষায় ফুটেছে প্রেমের জয়গান। কবিতা প্রেমিকার অভাব পূরণ করেছে কবিতার ভাষায়। প্রেমে ব্যার্থ হয়েই সুখের কিছু কথামালা কবিতা হয়ে দেখা দেয়। প্রকৃতির সাথে মিশে গেছে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। যেমনটি হয়েছে কবির উর্বশীর নৃত্যের মাদকতা ছোঁয়নি আমায় কবিতায়। কবির ভাষায়-
স্বর্গের উর্বশীর নাচের সুনাম শুনেছি অনেক
শুনেছি সে নৃত্য কলায় পারদর্শী,
মুগ্ধ দেবাতারা মুগ্ধ নয়নে দ্যাখে সে নাচ।
আমিও দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি বহুবার
তবে সে উবর্শী নয়
পাহাড়ী ঝর্ণার নৃত্যের ছন্দ।
অবিরাম নৃত্যের তালে বয়ে আসা ঝর্ণার স্রোত
নৃত্যের ছন্দে পাথরে করে আঘাত,
নুপূরের ঝংকারে মেতে ওঠে ধরণী
উর্বশীর পদাঘাতে যেমন স্বর্গের মাটি,
জল আর পাথরের ছন্দে, দেবতার মত
আমিও মুগ্ধ হয়েছি বহুবার।
মানুষের আদি সত্তার ভেতরেই বাস করে আদিমতা। মাঝে মাঝে সেই আদিমতার হিংস্র রূপ বেরিয়ে আসে। সমাজকে কুলষিত করে। সেসবও উঠে এসেছে অলোক আচার্যেও কবিতায়। আদিমতা যখন মনুষ্যত্বেও উর্ধে উঠে সমাজকে নোংরা করে তখন অলোক আচার্যের কবিতার ভাষা প্রতিবাদী হয়।
আমার ভেতরে কিছু আদিম মানুষ
আজও বড় বেশি হিংস্র
আজও আদিম নগ্নতায়
মেতে উঠি,
খোলাপথে ধর্ষিত হয়
আধুনিক সভ্যতা।
আমার অনুভূতিগুলো ক্রমাগতভাবে
ভোঁতা হয়ে আসে.
আমি তবুও পথ চলি
রাস্তাগুলো আমার নগ্নতার স্বাক্ষী হয়ে থাকে।
(আদিমতা)
প্রেমের মানসিক সাড়া আবেগিক। তার বাইরে গেলে শরীর প্রাধান্য পায়। মানুষের গোটা জীবনটাই প্রেম আর প্রতীক্ষায় কেটে যায়। মাঝখানে কিছুটা সময় ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মানুষ আবদ্ধ হতে ভালোবাসে। কোন কোন সময় শরীরের মায়ায় একটু বেশিই আটকে যায়। মুক্তি সেখানে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। যৌবন পেরিয়ে শরীর ক্ষমতা হারালে মায়ার বিষয়টি বোঝা যায়।
ভরা পূর্ণিমার কাল গেছে চলে
এখন মরা চাঁদ
গাঙের জলেও ছিল ভরা যৌবন
এখন মরা গাঙ।
জোয়ার ভাটা ছিল গাঙে
গাঙেরও ছিল যৌবনকাল।
এ মরা শরীর এখন আর টানেনা পতঙ্গ
পোড়া শরীরে এখন শুধুই ভাটার টান।
(যৌবনকাল)