ওমর আলী : নারী ও নিসর্গ প্রেমের কবি

আলাউল হোসেন

আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম রোমান্টিক কবি ওমর আলী যিনি ষাট দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত। তিনি তাঁর রচিত প্রেমের কবিতাসমূহের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। জীবদ্দশায় পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার আর মরণোত্তর একুশে পদক। কবিতায় শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকুলতা বিনির্মাণে তিনি নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার একজন অগ্রগামী কবি।

 
কবি ওমর আলীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এ দেশে শ্যামল রঙরমণীর সুনাম শুনেছি’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে এবং এই প্রথম গ্রন্থটিই তাকে কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়ে যান এই কাব্যের জন্যই। এরপর থেকে তিনি আর থামেননি। দুহাতে লিখে গেছেন। পর্যায়ক্রমে তার অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ ও দুইটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও তাঁর প্রথম এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ ‘এদেশে শ্যামল রঙরমণীর সুনাম শুনেছি’-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ সাদা ফুল সাদা আগুন প্রকাশিত হয় ২০১২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর পাবনা জেলার সদর উপজেলাধীন চর শিবরামপুরে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। বাবার বাড়ি ছিল একই উপজেলার চর ঘোষপুর গ্রামে। বাবা উজির আলী, মা আল্লাদী খাতুন। মাত্র দেড় বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান।

কবির শিশুকাল কেটেছে পদ্মার তীরে নিসর্গ সমৃদ্ধ সবুজ শস্য শ্যামল লাবণ্যময় চর ঘোষপুর ও চর শিবরামপুরে। পড়াশোনা শুরু করেন চর চাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপরে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৭/৮টি স্কুল পরিবর্তনের পর ঢাকার হাম্মাদিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫৫ সালে প্রবেশিকা পাশ করেন এবং ঢাকা সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে আইএ, ১৯৬৫ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাশ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয় থেকে ১৯৭৫ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাশ করেন। ১৯৭০ সালেই তিনি বগুড়ার নন্দীগ্রাম এমএইচ কলেজে ইংরেজির প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা কলেজ, সিরাজগঞ্জের সরকারি ইসলামিয়া কলেজ ও সর্বশেষ পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯ অক্টোবর ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহন করেন। দীর্ঘ ২ বছর অসুস্থ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে তিনি গত ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৭ সালে একুশে পদকে(মরণোত্তর) ভূষিত হন।

ওমর আলীর কবিতায় প্রেম একটি বিশিষ্ট উপজীব্য হিসেবে প্রাধান্য লাভ করেছে। মানবজীবনে প্রেমের মাহাত্ম্য ও প্রেরণা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন : ‘পৃথিবীতে ভয়কে যদি কেউ সম্পূর্ণ অতিক্রম করিতে পারে, বিপদকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করিতে পারে, তবে তাহা প্রেম।’ (উৎসব : ধর্ম)। ওমর আলীর কাব্যে বাঙালি নারীর রূপায়ন যেমন প্রাতিস্বিকতাপূর্ণ, তেমনি নারীত্বের অন্তর্মুখিতায় প্রেমের প্রাবল্য উচ্চকিত। তাঁর কবিতায় চিত্রিত রমণীরা পল্লী গাঁয়ের পরিবৃত্ত থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে গ্রামীণ আটপৌঢ়ে সাদাসিদে জীবনের মতোই তাদের প্রেম ও প্রত্যয় সরল।
ওইখানে চলো শুয়ে থাকি সারাদিন সারারাত
যেখানে সুন্দর নদী। শেয়াল কাঁটার ঘনবন।
বকুলের পাতা ঝরা মাঠ। কিংবা হাওয়ার আঘাত
তৃনশীর্ষে। ঝুমকো লতার বুকে আনে শিহরণ।
ওইখানে চলো শুয়ে থাকি সারারাত সারাদিন…
(গ্রামে)

বাংলার গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ ও জীবনধর্মের নানারূপ ওমর আলীর কবিতায় যে বাক্সময় হয়ে উঠেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পল্লী প্রকৃতি ও নারী প্রেম তাঁর কাব্যে উপজীব্য বলেই তিনি প্রেমের কবি, পল্লী-প্রকৃতির কবি বলে খ্যাতিমান হয়েছেন। পল্লী সমাজ ও পল্লীর নারীর জীবনধারা ও সাংস্কৃতিক চেতনা কীভাবে একজন কবির কবিতায় সাফল্য লাভ করতে পারে, তা তাঁর কবিতা পড়লেই সম্যক উপলব্ধি করা যায়। পল্লী গাঁয়ের শ্যামল রঙের রমণীর ভেতরে তিনি নিবিড়ভাবে খুঁজেছেন নিপূণ সৌন্দর্য।
এদেশে শ্যামল রঙরমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসিমাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এ দেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।
(এ দেশে শ্যামল রঙরমণীর সুনাম শুনেছি)

পল্লীর নারী, পল্লী জীবনের স্বাভাবিকতা ও নিগুঢ় চিত্র রূপায়ণে ওমর আলী অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে দুটো কাজ করেছেন। এগুলো হচ্ছে পল্লীর পরিবেশ ও নারীর প্রাত্যহিক জীবনের ‘সমগ্রতা চিত্রণ’। তিনি পল্লীর মানুষ। শহরের ইটপাথর তাকে কখনই আকর্ষণ করতে পারেনি। তাইতো পল্লীর পরিবেশ বর্ণনায় বাস্তবতার অভিনিবেশ স্থাপনের জন্য ওমর আলীর কৃতিত্ব অবিসংবাদিত। পল্লী নারীর রূপ-রস-প্রেম-ক্ষুধা তাঁর কাব্যের পরতে পরতে নানা লাবণ্যের আভরণে বিম্বিত হয়েছে।
‘তুমি জ্যোৎস্না যৌবনবতী চাঁদ তুমি চাকভাঙা মধুর চাঁদ
তুমি আমার পূর্ণিমা রাতের জ্যোৎস্না।
তুমি শরতের কাশফুল জোনাকি নক্ষত্রের মত সাদা…
আমি পান করি তোমার ঠোঁটে শরীরে সুমিষ্ট আঙুরের রস চাক ভাঙা মধু।
(তুমি জ্যোৎস্না যৌবনবতী চাঁদ)

অসহায় নারীর উপরে সামাজিক নিগ্রহের বাস্তবানুগ ঘটনাচিত্রও তাঁর অনেক কবিতায় সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। শ্যামবর্ণা স্বাস্থ্যবতী আদিম বাঙালি নারীকে তিনি তার সমস্ত ইন্দিয়ানুভূতি দিয়ে আবিষ্কার করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তার কবিতায় গ্রাম বাংলার মাটির অকৃত্রিম সোঁদা গন্ধ মেলে। প্রেয়সীর সংস্পর্শ, মিলন ও বিরহ, অফুরন্ত প্রকৃতি-সৌন্দর্যের রোমান্টিক অনুকল্পে তাঁর কাব্য বাক্সময় হয়েছে।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছ্বল দুটি চোখে, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাঁধ ভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ী তার দেহ থাকে ঘিরে।
(এ দেশে শ্যামল রঙরমণীর সুনাম শুনেছি )

তিনি কখনো চাননি, শহরের আট-দশ জন কবির মতো জীবনযাপন করে তার প্রসার, প্রতিপত্তি ও পরিচিত হোক। তিনি মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে, সর্বোপরি নিজের গ্রামকে। তাইতো তিনি নিজ পিতৃভূমি গ্রামকে ছাড়েননি। এখানে বসেই তিনি কবিতা লিখেছেন, পেয়েছেন স্বীকৃতিও। অধিকাংশ কবিই যখন প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতির পেছনে দৌঁড়াচ্ছেন, ছুটছেন রাজধানী ঢাকার দিকে, তখন তিনিই একমাত্র কবি যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা করেননি। এমনকি পাবনা শহরে সরকারি বুলবুল কলেজে চাকরি করেও পাবনা শহরে ঘরবাড়ি করেননি। বেছে নিয়েছেন পুরনো জীর্ণ-শীর্ণ বাসগৃহ নিভৃত পল্লী নিজ পিতৃভূমি কোমরপুরকে।
বন রমণীর কোল পূর্ণ হলো নতুন পাতায়
মানুষের পায়ে চলা পথ গেলো ফুলে ফুলে ছেয়ে,
যেখানে গাছের সারি সুউন্নত রহস্য মায়ায়,
অরণ্যের ঝিকিমিকি গোধূলির আলো খেলা পেয়ে।
(ফাল্গুন)

কবিতায় দুর্বোধ্যতা পরিহার করে তিনি সহজ সরল ভাষায় কবিতা লিখেছেন। এক্ষেত্রে তিনি নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য এনেছেন বিষয় নির্বাচন ও শব্দ ব্যবহারে। তিনি কবিতায় সংবাদকে কবিতার শরীর হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
‘আর তোমাকে নিয়ে বসবাস
এর চেয়ে আর তো কোথাও আমি আনন্দ দেখি না
রাজ সিংহাসন নয় শুধুমাত্র চাই যে তোমাকে
রাশি রাশি রত্মের এবং ঐশ্বর্যের পাহাড় গড়েও সুখ নেই
তুমি না থাকলে পাশে অতএব তোমাকে চাই…।’
(শুধুমাত্র চাই যে তোমাকে)

একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে। ওমর আলীর বড়ত্বও তার নিজস্ব বাক্যরীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মানে। সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তাঁর কবি হৃদয় সর্বদা প্রেম ও সুন্দরের পুজারী। তবে তাঁর কবিতায় প্রেমের ক্ষেত্রে শুধু মন নয়, দেহেরও ভূমিকা স্বীকার করা হয়েছে। রূপজ মোহ এবং প্রেম প্রথমত দেহকে কেন্দ্র করেই সূচিত হয়। তারপর দেহ থেকে দেহাতীত চৈতন্যে পৌঁছে। ওমর আলী তাঁর কবিতায় সৌন্দর্য সৃজন এবং প্রেমাধার হিসেবে দেহের প্রশস্তি গেয়েছেন। দেহকে প্রেমের স্থিতিতে সিদ্ধ করতে চাইলে, প্রক্রিয়া বর্জিত করলে অসঙ্গতি হয়। এ জন্য প্রেমের স্নিগ্ধতা ও মনো বিনিময়ের সত্যসন্ধ্যকে প্রকাশের জন্য দৈহিক প্রত্যয়ের কিছু কিছু অনুষঙ্গ ওমর আলীর কবিতায় ফুটে উঠেছে।
‘তোমার সুরভি ভরা শরীরের প্রচুর সম্পদ
সুন্দরী আমাকে দাও, নিই আমি দৃঢ় আলিঙ্গনে,
আমাকে তৃপ্ত করো তোমার মধুর চুম্বনে।
সুন্দরী আমাকে দাও তোমার ঠোঁটের মধুমদ।
(তোমার সুরভি)

ওমর আলী সারাজীবন নন্দনিকতার অবয়বে নিজের চিন্তা ও চেতনার ফসলকে গড়ে তুললেও একসময় পরলৌকিক জীবনের কথাও স্মরণে আসে তাঁর। মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই হয়তো বা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তিনি তাঁর চলে যাবার আগমনি বার্তা লিখেছেন এভাবে-
আমাকেও ফিরে যেতে হবে বহুদূরে
যেখানে ফেরার গান নেই এই নীল
আধাঁর রাত্রির দ্বীপ নিভে যাবে। সুরে
আসবে অনন্ত যতি।
(দূরের গান]

ফলত আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি-ওমর আলীর প্রেমচৈতন্য দেহাত্মবাদী না হলেও দেহের মাধুরীকে অস্বীকার করে বিকশিত হয়নি। তিনি নারী বিষয়ক যত কবিতা লিখেছেন, এগুলোর অধিকাংশতেই কিছু না কিছু দৈহিক সৌন্দর্য বা গুণের বর্ণনা পাওয়া যায়। 

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না