জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ১৯১১ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর। তিনি একজন প্রখ্যাত কবি ও গায়ক। তিনি অনেক উদ্দীপনামূলক দেশপ্রেমের গান লিখে বিখ্যাত হয়ে আছেন। ভারতের গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সংগীতস্র্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘বটুক দা’ নামে। শৈশব কেটেছে এক উত্তাল সময়ে, প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ এবং রুশ বিপ্লবের আবহে আর যৌবনে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন। অনন্য সাধারণ কাব্য ও সংগীত প্রতিভার অধিকারী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘নবজীবনের গান’ ও ‘মধু বংশীর গলি’ কে হাতিয়ার করে শুরু হয়েছিল চল্লিশের দশকের গণআন্দোলন। তখন মাঠে-ঘাটে-কারখানার গেটে নবজীবনের গান-
‘এসো মুক্ত কর, মুক্ত কর অন্ধকারের এই দ্বার
এসো শিল্পী এসো বিশ্বকর্মা এসো স্রষ্টা
রসরূপ মন্ত্র দ্রষ্টা
ছিন্ন কর ছিন্ন্ কর বন্ধনের এই অন্ধকার…’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি কবিতায় বলেছিলেন, ‘তোমার কীর্তির চেয়েও তুমি যে মহৎ!’ তাঁর আরও নানা বাক্যের মতোই এই কথাটির ভিতরেও একটি কূটাভাস ছিল। তা হলে কি কীর্তির বাইরেও আরও কিছু থাকে যা দিয়ে কোনও ব্যক্তির মূল্যায়ন করা যায়? সমস্যা এই যে আমরা কীর্তির নিরিখেই মানুষের মূল্যায়ন-সংক্রান্ত নানাবিধ ভাবনা ভাবতে অভ্যস্ত।
অথচ, কোনও কোনও মানুষের সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারা যায়, শুধুই কীর্তি নয়, সফলতা নয়, আরও কিছু, অন্তর্গত আরও একটা কিছু আমাদের ভিতরে খেলা করে। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তেমনই একজন। কীর্তিমান তো বটেই, উত্তরকাল সেই কীর্তির কথা সসম্ভ্রমে স্মরণ করবে, কিন্তু যাঁরা সেই মানুষটির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা জানেন, নিছকই কীর্তির মাপকাঠিতে মানুষটিকে বিচার করা কঠিন। অনূচিতও বটে। কারণ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ছিলেন আশ্চর্য একজন মানুষ।
তাঁর জন্ম যদিও পাবনার শিতলাই অঞ্চলের জমিদার পরিবারে, অথচ সেই বাড়ির সন্তান সটান নেমে এলেন মধুবংশীর গলিতে। বাম রাজনীতির দীক্ষাই তাঁকে টেনে আনল রুক্ষ্ম জীবনে। ‘ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু’- এ কথা এমন সার্থকভাবে আর ক’জনই বা বলতে পারেন তিনি ছাড়া?
তাঁর কথা উঠলেই গানের প্রসঙ্গ অনিবার্য। নবজীবনের গান থেকে রবীন্দ্রনাথের গান, দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র।
‘থেমো না থেমো না, মেনো না মৃত্যুর গ্লানি
মানি সবই মানি
ওদিকে শুনতে পাও কি ক্ষুধার কান্নার-’
‘ফেন দাও প্রাণ দাও
নবজীবনের সমীরণ চোখে মুখে ছড়াও’
‘কি করে ফিরাব তাদের মন্ত্র নেই তো মরা বাঁচাবার
ক্ষুধা তীর্থের যাত্রীরা
তোরা ফিরে যা-’
‘রঙিন আকাশে চাঁদের সুধা
পান করে নে তোরা আয়
পেয়ালা ভরা নব যৌবন
মধু ফুলে ভরা এই ঘন মৌবন’
‘এখানে লেগেছে আগুন ও ভাই
মায়া-ঘেরা ঘরবাড়ি পুড়ে হল ছাই
নিভাও আগুন বাঁচাও এ প্রাণ
নিভাও আগুন বাঁচাও রে…’
এরকম শত শত গান বিলবোর্ডের আলোয় ভাসা জীবনে অকস্মাৎ ধূসর পাণ্ডুলিপি বলে মনে হতেই পারে কারও, কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশকে, স্বপ্নপ্রদোষের মত একটা সময়ে সেই গান মানুষের মনে ঠিক কী উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, আজ এত বছর পরেও আমরা তা অনুভব করতে পারি। আক্ষরিকই, ‘নবজীবন’! এ ছাড়া আর কী বলেই বা সেই সঙ্গীতের ব্যাখ্যা করা যাবে?
মানুষকে আপন করে নেওয়ার শক্তি ছিল আশ্চর্য। তার সঙ্গে গান এবং আরও একটি সাঁকো ছিল সিনেমা। সত্যজিৎ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি ঋত্বিক ঘটকের দু’টি বিখ্যাত ছবি, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘মেঘে ঢাকা তারা’র সঙ্গীত পরিচালকও তিনি ছিলেন।
শুধু গণনাট্যের গানই নয়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ছিলেন ব্যবসায়িক প্রচারের আড়ালে থাকা এক অসাধারণ সংগীত প্রতিভা। জীবনের উপান্তে তাঁকে সংগীত পরীক্ষকের দায়িত্ব অর্পন করেছিল বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি। সেই সময় ওরা দেবব্রত বিশ্বাসের গানকে ব্রাত্য করে দিয়েছে। দেবব্রত বিশ্বাস আশা করেছিলেন-এবার বোধ হয় তিনি আবার গান করতে পারবেন। বিশ্বভারতীর নৃপেন্দ্র চন্দ্র মিত্রকে তিনি লিখেছিলেন, ‘শুধু জ্যোতিরিন্দ্র বাবুর ওপরেই যদি আমার রেকর্ড পরীক্ষা করবার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে আমি আবার রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড আরম্ভ করব। আর একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, মনে খুব আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম, হয়তো বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি আমার প্রতি একটু সহানুভূতিশীল হয়ে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকেই আমার রেকর্ড অনুমোদন করার করার দায়িত্ব দেবেন। কিন্তু হঠাৎ একটা মর্মান্তিক দুঃসংবাদ পেলাম- বটুক চলে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও পথে বসিয়ে গেল। ‘হরিজন’ হয়েই আমার শেষ কয়েকটি দিন কাটাতে হবে।’
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র একাধারে কবিতা, ছড়া ও গীতি কবিতা লিখলেও সনেট রচনায়ও সিদ্ধহস্ত। তাঁর সনেটে কোনো না কোনোভাবে দেশপ্রেম ও প্রকৃতির প্রতি নিখাদ ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়-
স্বপ্ন-প্রলাপ-মেদুর করেছে গতি
স্বদেশ আমার, বিদেশ আমার, নতি
জানাই তোমাকে। আরক্ত ঋতু-রঙে
বিচিত্র দিন, তব তোমাকেই নতি
বিদেশী স্বদেশ, স্বদেশী বিদেশী স্বদেশ প্রতি
জীবন ধারণে চক্র ঘষার জ্বালা
আশ্বিন দিনে তবু প্রেয়সীর মালা
তোমার আমার পয়ারে পয়ারে মিলে
জ্বলে ওঠে গান, ছন্দের এ নিখিলে
কত না দেশের প্রভাতে সন্ধ্যা এসে
আকাশে আকাশে নীল বাহু মেলে মেশে
ধ্বংশের পাশে তোমারই কোমল যতি
সারা মানুষের স্বদেশ তোমায় নতি
তিনি কতটা প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন, তা তাঁর শিশুতোষ কবিতা ‘ঘাসফুল’ পড়লেই বুঝা যায়। ‘ঘাসফুল’ কবিতায় তিনি ঘাসফুলের মনের কথা যেন প্রকাশ করেছেন। ঘাসফুল অত্যন্ত ছোট আর সুন্দর। তারা পৃথিবীতে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। মানুষ যেন ঘাসফুলকে পায়ে দলে নষ্ট না করে কিংবা না ছিঁড়ে এ জন্য তারা অনুরোধ করেছেন। কারণ ফুল ছিঁড়লে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া গাছের যেমন প্রাণ আছে, ফুলেরও তেমনি প্রাণ আছে। তাই ফুল ছিঁড়ে নেয়া অত্যন্ত অন্যায়। তাঁর মতে গাছে ফুল ফুটলে তা দেখে আমাদের আনন্দ পাওয়া চাই-
ধরার বুকে স্নেহ-কণাগুলি
ঘাস হয়ে ফুটে ওঠে।
মোরা তারই লাল নীল সাদা হাসি
রূপকথা নীল আকাশের বাঁশি-
শুনি আর দুলি শান্ত বাতাসে
যখন তারারা ফোটে।
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে নিয়ে বিষ্ণু দে তাঁর আলেখ কবিতাটি লিখেছিলেন-
‘এই কবিতা মিলনসাগর থেকে নকল করা
যে চঞ্চল, যে সুদূর তাকে চির করেছে পিয়াসী,
যে বুভুক্ষ খুঁজে ফেরে তীব্র নবজীবনের গান,
যে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠায় চিত্ত তার অশান্ত প্রয়াসী
যার সুর মর্মরিত অহর্নিশি তন্নিষ্ঠ হৃদয়ে তার;
কারণ শুনেছে সে যে গান আকাশে পাতিয়া তার কাণ
গম্ভীর পৃথিবী যার মৃদঙ্গে নিয়ত বলে; ধ্যান ভাঙো ধ্যান
একটি আকাশ ভেঙে হাজার আকাশ, হাজারের এক নীলাকাশ;
সেই স্বপ্নে সে ভরেছে উদ্গীথ উত্থিত তার ধ্যান।
তার মনে পদ্মার প্রবল ঢেউ, শুভ্র চরের প্রসার,
খরপ্রাণ কলকাতার দুরন্ত বিস্তার, মিলনসাগর থেকে নকল করা
আড্ডা সভা ধর্মঘট মিছিল উৎসব গণনাট্য গান
মন্বন্তর দেশভঙ্গ অনাচার জীবিকার ক্লান্তি আর কাজের উল্লাস
ঢেউ তোলে কবিতায় গানে যৌথ শিল্পের বিন্যাসে।
আজো তার শান্তি নেই দিল্লী মফস্বলে পাহাড়ে জঙ্গলে
হরিণের নৃত্যভঙ্গে, পাখির বিস্তর আর বিচিত্র সম্ভার
আনে না মনে তৃপ্তি, নানা চর্চা, মানবিক নানা কৌতূহলে
আজও তার মনের পরিধি ভাঙে জীবনের দ্বিধান্বিত ব্যাসে
নানান বেসুরে, বেতালের কূট ভেদাভেদে, অসম্পূর্ণতায়।
তাই সে কবিতা লেখে খাতায় বা ছেঁড়া খোঁড়া টুকরো পাতায়
তারপরে ভুলে যায় মমতায় লিখেছে যা এবং হারায়।’
সর্বোপরি বলা যায়, যে গুটিকয়েক মানুষ কোনদিন থামেননি, মন যাদের বারবার সজাগ ও সচেতন ছিল, ঐ বিশ্বাসে ও অনুভবে যাঁরা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাঁদের কৃত্য, আমৃত্যু যাঁরা পথ হেঁটেছেন, হেঁটেছেন মাথা উঁচু করে- জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র তাঁদের একজন।
