আলাউল হোসেন
মজিদ মাহমুদ সমকালীন বাংলা কাব্যে বিশেষভাবে উচ্চারিত একটি নাম। তিনি ক্ষণজন্ম একজন কবি। বিশেষ জীবন দর্শন ব্যক্সময়তা পেয়েছে তার কবিতায়। দৃষ্টিভঙ্গিগত স্পষ্টতা, তীক্ষè পর্যবেক্ষণ ও অনবদ্য মেদহীন প্রকাশ তার কবিতাকে করে তুলেছে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
১৬ এপ্রিল ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরদী উপজেলার চরগড়গড়ি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। লেখালেখি করছেন ছোটবেলা থেকেই। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১ম শ্রেণিতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে শুরু হয় কর্মজীবন। ছাত্রজীবনে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম বই ‘বউটুবানী ফুলের দেশে’ প্রকাশিত হয়। পরের বছর একটি গল্পের বই প্রকাশিত হয় ‘মাকড়সা ও রজনীগন্ধা’ (১৯৯৬); ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাহফুজা মঙ্গল’ প্রকাশের পরে মজিদ মাহমুদের কাব্য পাঠকের দৃষ্টি কাড়ে। ‘মাহফুজা মঙ্গল’ প্রকাশের সাত বছর পরে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাাশিত হয় ‘গোষ্ঠের দিকে’ (১৯৯৬); তারও পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হয় ‘বল উপাখ্যান’ (২০০১)। ‘বল উপাখ্যান’ বাংলা কবিতার কিঞ্চিত স্বাতন্ত্র্য সংকলন বলে উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবে না। ২০০২ সালে ‘আপেল কাহিনী’ নামে অপর একটি কাবগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে তার ‘নির্বাচিত কাব্য-সংকলন’ প্রকাশিত হয়।
মজিদ মাহমুদ শব্দের হৃৎপিণ্ড থেকে নিংড়ে আনেন প্রগাঢ় বন্ধনের প্রবল স্পন্দন। দূরত্ব দূর করার দুর্বার শক্তিতে প্রোজ্জ্বল তার পংক্তিমালা। তার আন্তরিক উচ্চারণ নিয়ত কাছে থাকার অম্লান অধিকার অর্জন করে নেয়। তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন একগুচ্ছ সতেজ এবং সপ্রাণ শ্রোতা তার সামনে বসে আছেন।
তার কবিতার অধ্যাপকীয় বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই, তিনি বরাবরই স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বনির্ভর। তিনি পাঠককে ক্লান্ত করেন না, বরং শ্রান্তিবিনোদের এক আকাশ নির্মল বাতাস তিনি কাব্যপ্রেমিক নামক অলৌকিক মানুষের সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বলেন : আসুন, কিছুটা সময় একটু কাছাকাছি বসি, পরস্পরকে মেলে ধরি এবং অন্তরকে ঢেলে দিয়ে বলি-
ভালোবাসাকে সবকিছু দাও
তোমার অবজ্ঞা এবং আজ্ঞাবহতা
তোমার আজকের এবং ভবিষ্যতের দিনগুলো
তোমার হৃদয় সাম্রাজ্য তোমার সুখ্যাতি
পরিকল্পনা, ঋণ, সঙ্গীত এবং জ্ঞান
ভালোবাসাকে দিতে কিছুই কার্পণ্য করো না।
(ভালোবাসা তোমার প্রভূ)
এভাবে ভালোবাসায় সমর্পিত হতে হতে তার উপলব্ধি এক নতুনতর অভিজ্ঞানে আর্দ্র হয়ে উঠে। তার কণ্ঠ যেন ধারণ করে দৈব উচ্চারণ : প্রকৃত প্রেম ঈশ্বরের মতোই সৃজনশীল এবং মহিমান্বিত। ফলে প্রেম ও পূজার রাবীন্দ্রিক সমন্বয়কে তিনি এমনভাবে স্বীকার করেন যে তার কথনভঙ্গি একান্তই মজিদীয় হয়ে ওঠে-
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি শ্রমণ গোতম বোধিসত্ত্ব মহাস্থবির
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি প্রবর্জিত ভিক্ষুসংঘ
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি ধর্মং শরণং গচ্ছামি;
মাহফুজাং শরণং গচ্ছামি
নির্বাণ শরণং গচ্ছামি
(মাহফুজাং শরণং গচ্ছামি)
এই উচ্চারণ-ভঙ্গিতে যে নির্মোহ এবং নৈর্ব্যক্তিক অভিপ্রায় উপস্থিত, তা তার কবিতার পক্ষে স্বাস্থ্যপদ হয়েছে। ফলে তিনি একা কথা বলেই চলে যান না, পাঠকের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে অনুভূতির এমন এক ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন তিনি, যেখানে অপ্রাপ্তি এবং অতৃপ্তিও উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
কবিতা কোনো আকাশ বাণী নয়, মেঘের বর্ষণও না বরং আকাশ মেঘ বরিষণ সবই কবিতায় ঠিক-ঠাক বসে কবিতা হয়ে যায় তাদের রূপ সৌন্দর্য আনন্দ কবির মনে বিরহ, বেদনা থেকে হর্ষ হুল্লোড়ে আমোদিত বা বিষাদিত করে এক শরীর পেয়ে যায় ভাষ্য ধারা, নানা উপমায় হয়ে ওঠে কল্পনার রাণী, প্রেমিকার মুখ সে কবিরই অবলোকন যার অস্তিত্ব শরীর ও তার মনোগঠন সম্পূর্ণই সামাজিক সত্তা। ‘আমার কবিতা শেষ না হতেই পাঠক বই ছুঁড়ে মারেন’ এই ছুঁড়ে মারাটা গ্রহণেরই এক নামান্তর এ কারণে যে কবিতা একটি মতও বটে একটি মতবাদের অংশও যার পক্ষ-বিপক্ষ রয়েছে, যা কাউকে না কাউকে আঘাত করে কাউকে তৃপ্তি দেয়। কেউ একজন বিভাজিত সমাজে নিয়ন্ত্রণকারী শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারে, মনমানসিকতায় তা লালন করতেও পারে, যদিও সে অবস্থানগত দিক থেকে প্রান্তিক; কিন্তু কবিতার সারসত্তায় সে তার উচ্চারিত বিষয়াবলীর সাথে একাত্ম না হয়ে বিচ্ছিন্ন বোধ দ্বারা চালিত হতে পারেন, সে ক্ষেত্রে যখন কবিতা পরিত্যক্ত হয় অর্থাৎ সে প্রান্তিক হয়ে পড়ে তখন কবির এই উপলব্ধি হওয়া পজিটিভ যে, তার কবিতা ঠিকমতো ঠিক জায়গাটিকে পিনবিদ্ধ করতে পেরেছে ও যথার্থ হয়ে উঠছে। বাস্তব যে কবিতা জনগণ এর মধ্য থেকে, জন-জীবনের ধারাবাহিকতা থেকে তাদের আচার-রীতি থেকে; গড়ে তোলা দীর্ঘ অভ্যাসরুচি থেকে সংগ্রহ করতে হয়, আসমানের কোনো সম্পর্ক নেই এর সাথে; আছে বস্তুজগত মনোজগত যা ভাবজগতের উদ্দীপনগুলো প্রজ্ঞায় জারিত করে নতুন রূপে নতুনের কণ্ঠ হয়ে ওঠার একটা সুর। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবলোকনগুলো নানা ইমেজের মধ্য দিয়ে একটা সংহত শরীর গড়ে নেয়, যা দৃষ্ট বিষয় থেকে ভিন্ন ভাষ্যে নবায়নের রীতিতে। এ ভাবে কবিতাগুলো আবার কবির মানস কবির নিকটে ফেরে, তার বিশ্বাসের সন্ধিতে। মজিদ মাহমুদ বড় কথাকে অল্পতে গম্যতার ভাষণে বিবৃত করেছেন এবং করতে পেরেছেন তার অধিকাংশ কবিতায়।
‘কবিতা তোমাকে লিখছি- রাত্রি জেগে
রক্তধারা প্রবল বেগে- নদী পর্বত দিগি¦দিক
কার সন্ধান বুঝি না ঠিক
কোথায় যেন একটি কথা রয়েছে গোপন
কোথায় যেন হয়নি ধরা একটি ক্ষণ
সেই অধরা হয়তো আমার কবিতা ঠিক’
(কবিতা)
কবিতার যৌবন অক্ষুণ্ণ রাখার নানাবিধ কৌশল মজিদ মাহমুদের আয়ত্তে। তাঁকে মৃদুভাষী বলা গেলেও মিতভাষী কিংবা স্বল্পভাষী বলা যায় কি-না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। তিনি আয়েশী ভঙ্গিতে শব্দ গেঁথে যান। তিনি চোখ রাখেন শ্রোতার দিকে। ফলে তার ব্যক্তিগত ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি থেকে দু’চারটি দুর্বল শব্দকেও তিনি আনমনে তুলে নেন। ভাবের ক্ষেত্রেও এই অনুযোগ উত্থাপন করা যেতে পারে। ফলে মজিদ মাহমুদকে পাঠ করতে করতে অনেক সময় হোঁচট খেতে হয়। পুরো কবিতার মধ্যে দু’একটি দুর্বল পঙক্তির অস্বস্তিকর অবস্থিতি তার অনেক সফল কবিতার স্বতঃস্ফূর্তিকে বাধাগ্রস্থ করে। এ বিষয়টি উদ্ধৃতি দিয়ে পরিষ্কার করা কঠিন। কারণ আমার এই বক্তব্যকে পুরো কবিতার পটপ্রেক্ষায় বিবেচনা করতে হবে। ‘অব্যক্ত কাঁন্নার গান’ নামের একটি কবিতায় কবি অত্যন্ত চমৎকার সরসতায় এবং সরলতায় জলপরী ও আকাশপরীর স্বপ্নমগ্ন শৈশবের স্মৃতিচারণ করেছেন। কবিতাটি পাঠ করতে করতে কবির ব্যক্তিগত পরী-পুকুরে একটু ডুব দিয়ে পাঠকের নিজস্ব শৈশবকেও উদ্ধার করতে ইচ্ছে করে। কবি প্রশ্ন করেন-
তোমরা কি সেই পরীপুকুরের কথা বলো
বলতে বলতে হাস
হাসতে হাসতে কেঁদে ওঠো মানবিক ব্যথায়
তখনও কবির দীর্ঘশ্বাস পাঠকের হৃদ্যন্ত্রকে নাড়া দিয়ে যায় কিন্তু কবি যখন আশঙ্কায় আক্রান্ত হন এবং বলেন-
আমার তো মনে হয় না তোমাদের সেই ব্যথা
কোনদিন জানা হবে আমার!
মজিদ মাহমুদের কবিতায় পৌরাণিক অনুষঙ্গে জীবনকে পাঠ করে তার মর্মমূলে আধুনিক জীবনযন্ত্রণাকে শিল্পিত করার প্রয়াস লক্ষ্য করার মতো। পুরাণকাহিনীকে তিনি এমনভাবে কবিতায় প্রয়োগ করেন যাতে এই কাহিনী না জেনেও কবিতার রসাস্বাদন ব্যাহত না হয়। অবশ্য পুরাণ জেনে পাঠ করলে কবির সৃজনভাবনার মৌল সূত্রটিকে আবিষ্কার সহজতর হয়। তাঁর পুরাণ প্রয়োগ-প্রকৌশল নিয়েই দীর্ঘ নিবন্ধ রচনা করা সম্ভব। কারণ তিনি পুরাণের শক্তিকে নিজের অভিপ্রায়ের অনুকূলে ব্যবহার করতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থারম্ভে কাঁটাচামচ প্রকাশন যে বক্তব্য সংযোজন করেছে, তার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা হলো-
মজিদীয় সিদ্ধির প্রাণকেন্দ্র তার পুরাণ আশ্রিত দর্শনদগ্ধতা, যেখানে পৌরাণিক পুনর্সৃষ্টির ছক ডিঙিয়ে তিনি ঢুকে পড়েন আধুনিক-ক্ষেত্রবিশেষে-আধুনিকোত্তর মণীষার শাসমূলে। শাস্ত্রশব্দ তিনি ধর্মাঞ্চল বা উপকথার এলাকা থেকে আহরণ করেন সত্য কিন্তু শাস্ত্রভাষার মর্মগত কন্ঠস্বর আদৌ উচ্চকিত করতে দেখি না তাকে। এক দুর্লভ শাস্ত্রনিরপেক্ষ ধ্যানের নিমজ্জল তার শিল্পভাষাকে আধ্যাত্মিকতার সারসত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এ বিশেষ স্বাতন্ত্রের প্রভা তার সৃষ্টির স্রোতপ্রবাহকে এক বিরলদৃষ্ট নতুন চাকচিক্যে মেলে ধরে।
উপর্যুক্ত বক্তব্যে কবিতায় পুরাণ ব্যবহারের প্রকৃত উদ্দেশ্যই মূর্ত হয়েছে। কারণ পুরাণের সঙ্গে ধর্মকাহিনীর যোগ নিবিড় হলেও একজন আধুনিক কবি ধর্মবিশ্বাস থেকে নয়, বরং জীবনের জটিল আবর্তে বিপর্যস্ত ব্যক্তির মানসিক বিভক্ততার পরিচয় দিতে গিয়েই পুরাণের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পুরাণ প্রয়োগের প্রেরণা কবি লাভ করেন নিজের ভেতর থেকেই। মজিদের কবিতা পাঠে এই বিশ্বাস আরো বদ্ধমূল হয়। তার কবিতায় পুরাণ আরোপিত নয়, যেন অনিবার্য। বিষয়ে কয়েকটি উদ্বৃতি দেয়া যেতে পারে-
কেনান! কেনান! বলে ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে নূহ
প্রভু! পুত্র ডুবে যায়
(পুত্র ডুবে যাচ্ছে)
‘হে পার্থ, প্রত্যেহ প্রাণীগণের মৃত্যু হচ্ছে; তবু
অবশিষ্টরা চিরকাল বাঁচতে চায়
এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে’
(বাতাসের ঘূর্ণাবর্ত ও গুরুপদ)
আমরা ছিলাম কবিতাতান্ত্রিক পরিবারের সন্তান
জলের যোনি থেকে উৎপন্ন হলেও
ক্যাসিওপিয়া আমার মা
ভূমিতে বিচরণশীল প্রাণীদের মধ্যে মানুষকেই
প্রথম বেছে নিয়েছিলাম
(প্রমিথিউস)
তাদের জন্য এই পুরস্কার হুর ও গেলমান
দিন পেরুলেই রাত্রি আমার হাত ধরে দেয় টান।
(নিষিদ্ধ কবিতাগুচ্ছ)
নিজপুত্র অশ্বথমাকে দিতে পারেননি গোদুগ্ধ
গুর্বী কৃপীর স্তন খাদ্যাভাবে শুকিয়ে গিয়েছিল
(আমার গুরু দ্রোণাচার্য)
পুরাণ ব্যবহারে তার কবিতা লাভ করেছে স্ফূটক সংহতি। কখনো তিনি প্রসঙ্গক্রমে পৌরাণিক প্রসঙ্গের শরণ নেন, আবার কখনো বা পুরাণ-কাহিনী অবলম্বন করেই পল্লবিত হয় পুরো কবিতা। উদ্ধৃতিসমূহ থেকে বোঝা যায়, তিনি অবলীলায় যে কোন মিথকেই প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন এবং এক্ষেত্রে তার সফলতা সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার বিবেচনায় ঈর্ষণীয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে তিনি অবলীলায় গ্রহণ করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মুখোমুখি তিনি মানবধর্ম তথা মানবপ্রেমের নজির স্থাপন করতে চেয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি অবলম্বন করেছেন নূহের কিস্তির প্রসঙ্গ। এখানে মজিদের শৈল্পিক সতর্কতা চোখে পড়ার মতো। মানুষের পাশে থেকে পুত্র কেনানের বিদ্রোহকে নূহ সমর্থন করেছেন ঘুমের ঘোরে। স্বপ্নাচ্ছন্ন নূহের এই কান্নার ভেতর দিয়ে আমরা তাকে প্রকৃত পিতা হিসেবে জেগে উঠতে দেখি। ‘পুত্র ডুবে যাচ্ছে’ কবিতায় মজিদের মুন্সিয়ানা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।
জন্ম-বিষয়ক প্রচুর শিল্পসফল পঙক্তি সৃষ্টি করেছেন তিনি। সন্তান উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটিকেই তিনি কবিতায় ধারণ করেন। এবং এক্ষেত্রেও সেই নির্মোহ উচ্চারণ কৌশল তাকে লিবিডো-ভারাতুর অশ্লীল কবির অখ্যাতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত-
সঙ্গম এবং সঙ্গমহীনতা ছাড়া
কী এমন পার্থক্য ছিল আমাদের
(পহেলা ভাদ্র)
কে তোমার প্রকৃত জনক
জননীও ডাকেনি তোমাকে
রক্তমাখা শূন্যতার প্লাসেন্টা ভেদ করে
স্বয়ম্ভূ দাঁড়িয়েছ তুমি
(নিঃসঙ্গতার পুত্র)
মজিদ মাহমুদ স্বকালের নানা অনুষঙ্গ কবিতায় ধারণ করেছেন। সময়ের চিহ্নকে পঙক্তিভুক্ত করার এই প্রবণতা কবির সংবেদনশীলতারই উজ্জ্বল স্মারক। অসঙ্গতির নানা অবয়বকে তিনি অবলীলায় উপস্থাপন করেন। কয়েকটি উদাহরণ দিই-
কবি গেছে শেয়ার মার্কেটে
আর আমি নীলকান্তের পোষা কুকুরের মতো
অভ্যাস বশে
নদীর কিনার ঘেঁষে কেবল তোমাকেই খুঁজি
(স্টক এক্সচেঞ্জ)
মজিদ মাহমুদ প্রকরণ সচেতন শিল্পী। তাঁর পরিমিতিবোধ প্রশংসাযোগ্য। সুনির্বাচিত শব্দ তার আজ্ঞাবহ হলেও শব্দকে দিয়ে তিনি এমন কিছু করান না, যা পাঠককে বিব্রত করতে পারে। তিনি উপমার সাহায্যে অভিপ্রায়কে স্পষ্ট করে তোলেন। ক্রমাগত উপমা ব্যবহার করে কখনো বা রচনা করেন ব্যক্তিগত বিবেচনার বর্ণিল সেতু যা পাঠকের সঙ্গে কবির বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। ব্যবহৃত উপমায় কবির বিশ্লেষণপ্রবণতার পরিচয় ধরা পড়ে। একটি ভাব ও বিষয়কে নানাভাবে দেখেও যখন কবির তৃপ্তি নেই, তখন বুঝতে পারি এই শৈল্পিক অতৃপ্তিজনিত অভিনবত্বের মধ্যেই কবির সৌন্দর্যচেতনা মূর্ত হতে চেয়েছে। কয়েকটি উপমা-
তুমি একমাত্র সন্তানের জননীর মতো
হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়বে আমার অপুষ্ট তনুর উপর
(বল উপখ্যান)
পথভ্রষ্ট হলে তার দূত পাঠিয়ে
বিশৃঙ্খল মেষের পালের মতো তিনি একত্রিত করেন
(ঈশ্বর আমাকে বাঁচতে দেয়নি)
মজিদ মাহমুদ কবিতার শরীর-স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীন নন। যদিও ছন্দ নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিচয় তার কবিতায় নেই। তিনি গদ্যছন্দেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। টানা গদ্যে লেখা যাত্রার প্রথম দিনগুলো (২০০৬) কাব্যগ্রন্থের বেশ কয়েকটি কবিতায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। একটি কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করি-
ঝরা পাতার মধ্য দিয়ে তুমি যখন গড়িয়ে যাচ্ছিলে একটি মণ্ডুকের মাথার ওপর বৃষ্টির
ফোঁটা বিচূর্ণ হয়ে তোমার মাথার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। তুমি একটি ঘাসের নিচে
গড়িয়ে গড়িয়ে সন্তর্পণে মাটির কৌশিক ভেদ করে পাতালের দিকে চলে যাচ্ছিলে।
আমিও রাজপুত্রের মতো তোমার এই সব গোপন যাত্রার পথ অনুসরণ করে এগিয়ে
যাচ্ছি সমুদ্রের বিছানার দিকে।
(ঝরাপাতা)
মজিদ মাহমুদের কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের চলমান বাংলা কাব্যের ধারাবাহিকতা লগ্ন হলেও বৈচিত্র্যপূর্ণ। কত কিছু রয়েছে তার কবিতায়, রয়েছে নানারকম মনস্তাত্ত্বিক বিষয়-আশয়। তার কবিতা কোনো জটিল বাক্যবন্ধে বা অসম্ভব কল্পিত কল্পে প্রতিভাষ নয় বরং ভাষ্যগুলোর একটা সরল ভঙ্গি নিয়ে নাচতে নাচতে উঠানে নামে- গড়ে কাব্য-শরীর। আপাতত সামান্য বিষয় কখনও কখনও চলমান জীবনে তুচ্ছ বিষয়ও বড় অর্থ নিয়ে তৈরি করেন কাব্য যা দক্ষ হাতেরই রূপান্তর। আর তাই তার ভূমিকা কাব্যে ঠিক ঠিক বলে দিতে পারেন ‘যে কবিতা তিনি লিখতে চান তা লেখা হয়নি’ আর তাই তিনি এও বলেন যে ‘এই কবিতাগুলো কোনো মরণশীল পড়তে পাবে না; এই কবিতাগুলো চিতায় দাহ করার আগে, সমুদ্রে বিমানধসের আগে, মৃতদের আত্মা মহাকাশে উত্থিত হওয়ার আগে, গ্যংরেপে হারিয়ে যাওয়ার আগে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগে, প্রেম-বঞ্চনার আগে- স্বয়ং ধ্বনিত হয়ে উঠবে’ এই তার বিশ^াস এই তার প্রথিত প্রজ্ঞায় সংশ্লেষিত মনন আর সে কারণে কবি মজিদ মাহমুদ চলমান সময়ে একটু অন্যরকম এবং তার কবিতার ধারাভাষ্য গঠনশৈলী ভিন্ন মাত্রা পায়।
