আলাউল হোসেন
দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশি বাঙালি কবি, লেখক ও সাংবাদিক, যিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশ থেকে নির্বাসনের পর বর্তমানে জার্মানিতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তিনি বর্তমানে একজন ব্রডকাস্টিং সাংবাদিক। তিনি একজন আধুনিক কবি যিনি সত্তর দশকের কবি হিসাবে চিহ্নিত। বড় ব্যতিক্রমী এক জীবন তার। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় পরবাসে। নির্বাসিত জীবনেও ভোলেননি প্রিয় মাতৃভূমিকে। ফলত সুদূর জার্মানির বার্লিন থেকে লেখা আত্মজীবনী উৎসর্গ করেছেন বাল্যের প্রিয়, ইছামতি নদীকে।
দাউদ হায়দার ১৯৫২ সালের ২১ ফের্রুয়ারি পাবনা জেলার দোহারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকে তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত একজন মানুষ। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। তার কবিতায় প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ছায়াপাত ঘটেছে। “জন্মই আমার আজন্ম পাপ”, “যে দেশের সবাই অন্ধ”, “নারকীয় ভুবনের কবিতা”, “পাথরের পুঁথি” তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন জার্মানির বার্লিন শহরে। জার্মান বেতার কেন্দ্রের ‘ডয়চে ভেলে’র বাংলা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
সত্তর দশকের শুরুর দিকে দাউদ হায়দার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের কোন এক কবিতাকে ‘দ্যা বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া’ সম্মানে ভুষিত করেছিল। সংবাদের সাহিত্যপাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, তিনি ঐ কবিতাতে হযরত মোহাম্মদ (সা.), যিশুখ্রীষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি ছিল যা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিল। তার সংস্ অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সঙ্কলিত আছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন।
আশির দশকের শেষ সময় থেকে দাউদ হায়দার বার্লিনে। বাংলাদেশ থেকে যত দূরে তাকে যেতে হয়েছে, বাংলাদেশ তাকে তত বেশি আঁকড়ে ধরেছে। দেশে না ফিরলেও সে ফেরার স্বপ্ন দেখা থামায়নি। তার কবিতার প্রধান সুর, এখনো, নির্বাসন যন্ত্রণা। তিন দশকের বেশি সময় দেশের বাইরে, পূর্ব-পশ্চিমের হেন দেশ নেই, যা সে চষে বেড়ায়নি। কলকাতা বা বার্লিন, প্যারিস বা কোপেনহেগেন, কবিতার খাতা নিয়ে তন্ন তন্ন করে ঘুরেছে। অথচ সে খাতায় যখন কবিতার শব্দ বসিয়েছে, ঘুরেফিরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ফেলে আসা স্বদেশ। যখনই গভীর, গোপন যন্ত্রণার কথা বলেছে, বলেছে স্বপ্ন ও ভালোবাসার কথা, তখন কেবলই শোনা গেছে ‘বাংলাদেশের’ নাম।
হে জীবন, তোমাকে সুখের মুখ দেখাবো বলে
সেই কবে থেকে প্রতীক্ষপ্রন্ত
এক যুগ কেটে গেল, কলকাতায়
এখনো আশায় বসে আছি
যদি কেউ ফেরায় সস্নেহে, পিতৃদেশে।
দাউদ হায়দার সত্তর দশকের তারুণ্যোজ্জ্বল কবি। তার কবিতায় প্রেম বন্দনা, স্বতন্ত্র জীবনবোধ, প্রকৃতি, চিরসুখের নস্টালজিয়া প্রভৃতি বিষয় প্রযুক্ত হয়েছে। তিনি জীবনবাদী কবি। প্রেমিক কবি। তিনি সুস্থ জীবনদর্শন ও ভালবাসার নির্মলবোধে উদ্দীপ্ত। প্রাজ্ঞ ভাবনায় তিনি জাগতিক জীবনের সব ধরনের যন্ত্রণাকে জয় করেছেন। যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলে বিপর্যস্ত মানুষদের অন্যরকম এক জীবন সন্ধান দিতে ব্রতী হয়েছেন। তার ভাবনা সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে জীবনকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। দাউদ হায়দারের কবিতা বক্তব্যপ্রধান। সনাতন রীতি থেকে বেরিয়ে তিনি বিষয়বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে নির্মাণ করেছেন তার কবিতার অমল অঞ্চল। দাউদ হায়দারের কবিতার ভুবন বিদ্রোহের আগুনে ঝলসানো নয়। জীবন অন্বেষণে ভালবাসার খুনসুটিতে, বক্তব্যে উজ্জ্বল। তার কবিতায় শিল্পের দরিদ্রতা নেই। কাব্যিকতার বিত্ত আছে। রকমারি সমস্যার আবর্তে শ্লথ জীবনে দাউদ কবিতার চঞ্চলতা দিয়ে গতিময়তা এনে দিয়েছেন। তিনি বৃষ্টিভেজা ভূ-ভাগে কবিতার বীজ রোপণ করেছেন মহানন্দে। সমুদ্রজলে তিনি কবিতার এলোমেলো ভেলায় ভেসে গেছেন। জীবনের অর্থ পাল্টে গেছে তার কবিতার সংসারে। জীবনকে দাউদ ভিন্ন চোখে দেখেছেন। তার কবিতায় জীবনের বহুমাত্রিকতা এসেছে নানাভাবে। প্রেম, প্রাপ্তি, আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসার বিশালতা, স্মৃতি তার প্রাণশক্তির উৎস। তার দুঃখের সঙ্গে একটি শহরের অনেক মানুষের দুঃখ একটি বিন্দুতে মিশে গেছে। ঢাকা শহরের প্রতি তার প্রেমমগ্নতা তৈরি হয়েছে মিলিত দুঃখ থেকে। দাউদ হায়দারের স্বজন তালিকায় সংযোজিত হয়েছে একটি শহরের নাম। যে শহরের মানুষ দুঃখ-যন্ত্রণায় যাপন করে দুঃখময় দীর্ঘরাত। চিরসহিষ্ণুতায় তবু বেঁচে থাকে দাউদ হায়দারের প্রিয় ঢাকা শহর। ঢাকাকে নিয়ে তার ভালোবাসা মাখা উচ্চারণ :
ঢাকা এমন কোন শহর নয়
যাকে আমি শোকেসে সাজিয়ে রাখতে পারি
তবু কেন জানি আমি এই ঢাকাকেই ভালবাসি
বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকি
সকাল দুপুর সঙ্গে নিয়ে হেঁটে বেড়াই
ঢাকা এমন কোন সুন্দর শহর নয়
ঢাকা আমার দুঃখ বোঝে
আমি ঢাকার দুঃখ জানি।
দাউদ হায়দারের কবিতায় দুঃখ আক্রান্ত যন্ত্রণাযাপিত এক কবির পরিচয় পাওয়া যায়। নিঃসঙ্গতার সঙ্গে সখ্য করে প্রকৃতির সঙ্গে অনুভব বিনিময় করেছেন দাউদ হায়দার। যাবতীয় মনোদ্বন্দ্বের অনুভূতি নিয়ে তিনি আকণ্ঠ পান করেছেন কবিতার অমলজল। তার কবিতার প্রান্তর সবুজ মখমল সজীবতায় প্রকরণগত সুষমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি শব্দবিলাসী কবি। তার শব্দের সম্ভার থেকে তিনি ইচ্ছেমতো শব্দ খরচ করেছেন। তার ভাষাভঙ্গি, উপমার ব্যবহার, চিত্রকল্প, প্রতিটি উপাদানে রয়েছে শিল্পের ছোঁয়া। দাউদ হায়দারের সব কবিতা আলাদা সৌন্দার্যে অনন্য। দাউদ হায়দারের শিল্পবোধ, সৃজনশীলতা, নির্মাণ কৌশল, অনুভূতির প্রকাশ ক্ষমতা প্রভৃতি দক্ষতা তার কবিতাকে সুখপাঠ্য শিল্পনন্দন করে তুলেছে। দাউদ হায়দার তার নিজস্বতা দিয়ে গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছেন মোহনায়। তার লৈখিক রীতির ভিন্নতা, তাঁর শিল্পচেতনা, তাঁর নিরলস শ্রমের কারণে মহিমান্বিত কবি দাউদ হায়দার নির্মাণ করতে পেরেছিলেন কবিতার আপন বৈভব। তিনি জগতের কুৎসিত বিবর্ণতাকে তার পঙক্তিমালার বর্ণিলতায় আচ্ছাদিত করেছেন। যাবতীয় কল্যাণময় শুভতার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা। তিনি দর্শনপ্রেমিক, তার মধ্যে প্রকৃতি সৌন্দর্যের স্বতঃস্ফূর্ত মগ্নতা। প্রেমপ্রবণতা বিস্তর বিষাদ ভালবাসার আবেগময় সুখানুভূতি বর্ষার জল, বন্ধু আড্ডা প্রভৃতি বিষয় পরিস্ফুট হয়েছে দাউদ হায়দারের কবিতায়। কোন নান্দনিকতাই তার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। তার পরিণত মনের ভাবনায় জীবন আবিষ্কৃত হয়েছে নতুনভাবে। তিনি কবিতার প্রাণশক্তি দিয়ে পরিবর্তন করতে চেয়েছেন সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি দাউদ হায়দারের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ’, ‘নারকীয় ভুবনের কবিতা’, ‘এই শাওনে পরবাসে’, ‘আমি ভাল আছি’, ‘তুমি’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’ প্রভৃতি। দাউদ হায়দার তার কবিতায় অন্ধকারের সঙ্গে বিরোধ করেছেন তুমুলভাবে। কবিতাকে আঁধার আগ্রাসী করে রূপায়িত করেছেন। আলোময় আগামীর আকাক্সক্ষা তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন। তার কবিতা আবেদনময়। অর্থবাহী। তিনি গভীর মনোস্তাত্তিক বিশ্লেষণে জীবনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি হাল্কা মেজাজের কবিতা দিয়ে খ্যাতিপ্রার্থী কখনও হননি। তার কবিতার মুখ্যমন্ত্র গভীর ‘পর্যবেক্ষণ’। তিনি দুঃখকে গভীরভাবে জানার জন্য উদয়াস্ত দুঃখের সঙ্গে পরিভ্রমণ করেছেন তার মনোজগত। এ অভিজ্ঞতা দিয়ে উচ্চারণ করেছেন :
এ নয় রক্তস্নাত বিজয় বৈজয়ন্তী সখী
এ বড় দুঃসময় আমার মনোভুবন জুড়ে দুঃখ দুঃখ খেলা
দুঃখেরই দিন আজ হাটে ঘাটে ভালবাসা পরাজয়
বেশ আছো সহসা কোনো সম্পাত কুড়াতে যাওনি এ বেলা
দাউদ হায়দার তার কবিতার গতিময়তা দিয়ে দুঃসময়কে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। অবাধ উদ্দামতা, স্পন্দিত তারুণ্যে তার কবিতা দুর্বার। দাউদ হায়দারের কবিতা সব প্রতিরোধের দেয়াল ভেঙ্গে উত্তীর্ণ। তার সৃষ্টি কুশলতা, ছান্দিক নৈপুণ্য বিষয়বৈচিত্রের বিশালতা তার জগতকে দিগন্ত প্রসারিত করেছে। দাউদ হায়দারের কবিতার প্রতিটি উপাদানকে কাব্যিকভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। প্রাচীনতা পেছনে ফেলে দাউদ হায়দার সাহসী পায়ে হেঁটে গেছেন নতুনত্বের পথে। তার কবিতা নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় উন্মোচিত হয়েছে। দুঃখময়তা-বিষন্নতা তার কবিতাকে যেমন আপ্লুত করে তেমনি আনন্দ-উল্লাসের প্লাবন তার সীমানাকে ভাসিয়ে দেয়। বিচিত্র প্রতিভার নিদর্শন দাউদ হায়দারের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। তার কবিতায় পেছনে ফেলে আসা সময় নানাভাবে উঠে আসে।
করতালির মতো বৃষ্টির শব্দ তার স্মৃতি জাগিয়ে দেয়। বর্ষার অবিরল জল তার মধ্যে ছন্দময়তা তৈরি করে। তিনি স্বতন্ত্র ছন্দে উচ্চারণ করেন :
আকাশে আজ মেঘ ডেকেছে গুরু
হৃদয় মাঝে বিরহ ব্যথা শুরু
হাওয়ায় কাঁদে তুষা নিবারণী
জলের উপর বিগত মুখখানি
ঘে উঠেছে বিধুর নীলাকাশে
বকুল ঝরে দীপ্ত পরবাসে।
মনে পড়ে শুধুই মনে পড়ে
কোথায় আমার কোথায় তুমি ওরে।
দাউদ হায়দারের কবিতায় রয়েছে জোছনার লাবণ্য। আমাদের সাহিত্যের পরিণ্ডলে তার নক্ষত্র প্রতিম কবিতা বৃষ্টির মতো অবিরল। আলো ছড়িয়েছে। তিনি কবিতার কলতান দিয়ে মুখর করে রেখেছেন প্রতিটি প্রান্তর। দাউদ হায়দারের কবিতার মহাদেশ সান্ধ্য আলোয় গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রামের মতো সজীব-অপরূপ। তার কবিতার প্রসঙ্গ বহুমাত্রিক। তিনি উচ্চতর মানবিক বোধে আক্রান্ত কবি। সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষের অযথা উল্লাস তুচ্ছ বিষয়ে উৎসব উদযাপন তাকে আহত করে। তিনি আদিগন্ত কাঁপিয়ে উচ্চারণ করেন :
আমাদের যৌবন নেই
যৌবনে উৎসব নেই
উৎসবে উল্লাস নেই
উল্লাসে উৎসাহ নেই
জন্মেও মধু নেই মৌচাকে মৌমাছি নেই
বল নেই দোর নেই কিচ্ছু নেই।
আমার সন্তানের জন্ম হলে
আমি বলি প্রভূ ওকে মৃত্যু দাও
ও যেন যন্ত্রচাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যায়
তাহলে আমার আর কাফনের কাপড় কিনতে
হবে না, প্রভূ ওর মৃত্যুই হবে আমার পরম উৎসব।
দাউদ হায়দারের হীরকগুচ্ছ কবিতায় আমাদের কবিতার জগত দ্যুতিময়। তার কবিতা চর্চা আমাদেরকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। তিনি কবিতা লেখার স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে এখন পরবাসে। দাউদ হায়দারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কামনা করি।
