আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিন্তার ঔজ্জ্বল্যে ভাস্কর

আলাউল হোসেন

কবি, গীতিকার, টিভি-উপস্থাপক এবং শিক্ষক আবু হেনা মোস্তফা কামাল জনপ্রিয় একটি নাম। গবেষক হিসেবে বাংলা ছাপাখানা এবং সাহিত্যচর্চা বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল। বিশেষ করে বাংলা সাময়িকপত্রের প্রথমপর্বে ছাপাখানায় সাহিত্যের প্রভাব আবিষ্কারের দিকে ছিল তার প্রবল ঝোঁক। উচ্চতর গবেষণা করে তিনি সে প্রবণতার প্রমাণ রেখেছেন। এছাড়া শিল্প, শিল্পী এবং কবিতার কাঠামো ও সৌন্দর্য বিষয়ে তার মৌলিক মননশীল রচনা বাংলাদেশের প্রবন্ধ-সাহিত্যে বিশেষ সংযোজন। কথক কিংবা প্রাবন্ধিক মোস্তফাও ছিলেন যেন কবিতাচ্ছন্ন মানুষ। নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং বাংলা একাডেমির মতো শিল্প-বিকাশ ও জাতির মনন সাধনার প্রতিষ্ঠানে। তিনি ছিলেন শিল্পের ও মননের উদ্যমী ও সাহসী লিডার। দেশের কয়েকটি স্বনামখ্যাত কলেজে এবং প্রধান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনার পর বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রধানের দায়িত্ব পালন করে তিনি সৃষ্টি করেছেন বিরল দৃষ্টান্ত। আর সহজবোধ্য এক চেতনার বিস্তার আছে আবু হেনা মোস্তফা কামালের গানের কথায় ও সুরে। বাংলাদেশের সঙ্গীতভুবন এবং ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘ওই যে আকাশ নীল হলো আজ সে শুধু তোমার প্রেমে…’ আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা এ গানটি দিয়ে। এ রকম অনেক হৃদয় হরণকারী, জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা আবু হেনা মোস্তফা কামাল। প্রকৃতি ও পরিবেশকে আপন অনুভবে সাজিয়ে তুলেছেন তিনি সঙ্গীতের সুরের ধারায়।

পাবনা জেলার সদর থানার গোবিন্দা গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম। বাবা এম. শাহজাহান আলী ছিলেন প্রথম জীবনে স্কুলশিক্ষক, পরে কোনো অফিসের হেডক্লার্ক। অকালেই মারা যান তিনি। আবু হেনা মোস্তফা কামালের মা খালেসুননেসা দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। গান ভালো গাইতেন। ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। আবু হেনা মোস্তফা কামালরা ছিলেন তিন ভাইবোন। সবার বড় বোন সাবেরা খাতুন শামসুন আরা। সাবেরা খাতুনের স্বামী খ্যাতিমান সাংবাদিক কেজি মুস্তাফা। সেই সূত্রে সাবেরা খাতুন সাবেরা মুস্তাফা নামেই পরিচিত। সাবেরা মুস্তাফা অধ্যাপক এবং মঞ্চ ও বেতারের অভিনেত্রী ছিলেন। তাঁর পরে আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ভাইবোনদের মধ্যে ছোট আবুল হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল। বাংলাদেশ বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন এবং গীতিকার হিসেবে তিনিও সুপরিচিত।

পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করন। এ পরীক্ষায় আবু হেনা ত্রয়োদশ স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৪ সালে তিনি আইএ পরীক্ষায় সপ্তম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি বাংলায় অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আবু হেনা অনার্স ও মাস্টার্স উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালেই আবু হেনা গীতিকার ও কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জে অল্প কিছু দিন পড়িয়ে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজে ১৯৬০ সালের শেষের দিকে। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে চলে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে তিনি সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি চলে যান লন্ডনে পিএইচডি করার জন্য। ১৯৬৯ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে পুনরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উপাচার্য আবুল ফজলের আগ্রহে আবু হেনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। এ সময় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আপন যৌবন বৈরী’’ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

আবু হেনার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ : ‘যেহেতু জন্মান্ধ’ ১৯৮৪ সালে এবং ‘আক্রান্ত গজল’ প্রকাশ পায় ১৯৮৮ সালে। তাঁর প্রবন্ধের বই ‘শিল্পীর রূপান্তর’ ১৯৭৫ সালে এবং ‘কথা ও কবিতা’ প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে। ‘আমি সাগরের নীল’ আবু হেনা মোস্তফা কামালের একমাত্র গীতি সংকলন। প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। আবু হেনার প্রতিটি গানই ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি নিজেও গায়ক ছিলেন।
কবিতায় থাকে ছবি। ছবিতে থাকে কবিতার উপাদান ও গল্প। কবি কখনো ছবি থেকে খোঁজেন কাব্যের উপাদান। আবার কোনো কোনো চিত্রশিল্পী তার রঙতুলিতে যে ছবি আঁকেন, তাতে হয়তো প্রবেশ করে নিবিড় কাব্যময়তা। আবার প্রকৃতির যে ছবি, ভূখণ্ডের যে মানচিত্র, তা-ও কবিকে টানে প্রবল আকর্ষণে। প্রসঙ্গত, আমরা আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘ছবি’ কবিতার পাঠ নিচ্ছি। এ কবিতা আবৃত্তি-যোগ্যতার কারণে পাঠকমহলে বেশ পরিচিত ও সমাদৃত। শ্রোতার কানেও এ কবিতা জাগায় নিপুণ আনন্দ-
আপনাদের সবার জন্য এই উদার আমন্ত্রণ
ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান
অবশ্য উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো মনোহারী স্পট আমাদের নেই
কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না-
আপনার স্ফীত সঞ্চয় থেকে
উপচে-পড়া ডলার মার্ক কিংবা স্টারলিংয়ের বিনিময়ে যা পাবেন
ডাল্লাস অথবা মেম্ফিস অথবা কালিফোর্নিয়া তার তুলনায় শিশুতোষ।
আসুন, ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান
রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা
আপনি কোন শিল্পীর কাজে পাবেন না,
বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কি?
অথচ দেখুন, এই বিশাল ছবির জন্য ব্যবহৃত সব উপকরণ অকৃত্রিম;
আপনাকে আরও খুলে বলি : এটা, অর্থাৎ আমাদের এই দেশ,
এবং আমি যার পর্যটন দফতরের অন্যতম প্রধান, আপনাদের খুলেই বলি,
সম্পূর্ণ নতুন একটি ছবির মতো করে
সম্প্রতি সাজানো হয়েছে!
খাটি আরজবংশ সম্ভূত শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে ত্রিশ লক্ষ কারিগর
দীর্ঘ ন’টি মাস দিনরাত পরিশ্রম করে বানিয়েছেন এই ছবি।
এখনো অনেক জায়গায় রঙ কাঁচা- কিন্তু কি আশ্চর্য গাঢ় দেখেছেন?
ভ্যানগগ- যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন- কখনো, শপথ করে বলতে পারি
এমন গাঢ়তা দ্যাখেননি!

এই ছবির মতো দেশের- থিম!’- কী আছে এই কবিতায়? প্রকৃতি? রঙ? পর্যটনের বিজ্ঞাপন? না-কি এখানে তিনি সাবধানে এঁকেছেন পুরো বাংলাদেশের মানচিত্র। সোজা কথায় বলতে গেলে এতে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের গল্প। ‘ত্রিশ লক্ষ কারিগর’, ‘দীর্ঘ ন’টি মাস’ কি সরাসরি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা আর সংগ্রামের সময়-পরিসরকে নির্দেশ করে না? আর ‘শিল্পীর কঠোর তত্ত্বাবধানে’ বলতে কবি কাকে বুঝিয়েছেন। তিনি কি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নন? তাহলে ‘ছবি’ কোনো প্রকৃতি-বর্ণনার কবিতা নয়, রাজনীতি-বিষয়ক কবিতা। একটি রাষ্ট্রের গঠন-প্রক্রিয়া, নেতৃত্ব, জাতীয়তাবোধ আর কল্পনায় ও চেতনায় আঁকা স্বাধীনতার ছবিই এঁকেছেন কবি এই কবিতায়।

আবেগপ্রবণ কবি আবু হেনা কবিতায় যেমন তেমনি সঙ্গীত রচনায় প্রকৃতি ও আপন অনুভবকে জড়িয়ে-মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন। বাণীহীন ও উদ্দেশ্যহীন রচনা তাঁর নেই বললেই চলে। বক্তব্যের প্রবণতাই তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য। চিন্তাহীন অনর্গল উচ্চারণ তাঁর কবিতা ও গদ্যের কোথাও নেই, বরং তাঁর গদ্য-পদ্য সমস্ত রচনায় পাওয়া যাবে চিন্তার ঔজ্জ্বল্য। এ কারণেই অনেকের লেখার সাথে তাঁর তুলনা করা যায় সামান্যই। আব্দুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় যদি বলি তাহলে বলতে হয়, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল কবিতা ও গদ্য কখনোই বেশি লেখেননি, কিন্তু তাঁর যেকোনো রচনা সুচিন্তিত ও সুলিখিত। হয়তো তাঁর তিন দশকের অধিককালের সাহিত্যচর্চায় ছোটখাটো ছেদ ও বিরতিও পড়েছে, কিন্তু তাতে তার রচনায় শ্যাওলা ধরাতে দেয়নি কখনো। যেখানে তাঁর সমসাময়িক অনেকের লেখায় মরচে পড়ে গেছে বা সৃজনশীলতা নিঃশেষিত কিংবা পুনরাবৃত্তিমুখর- সেখানে আবু হেনা মোস্তফা কামালের রচনা এখনো আজকের এই আশ্বিনের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের মতোই প্রফুল্ল ও দীপ্যমান। এর কারণ মনে হয়, তার চিন্তা ও প্রেরণার অবিশ্রাম জাগৃতি ও উৎসারণ। ফলে লেখা যখন হয়নি, তখনো অন্তঃপরিগ্রহণের কাজ ভেতরে ভেতরে চলছেÑ শিল্পী তার উন্মুখিতা সতত জীবন্ত ও জাগ্রত রেখেছেন। এ জন্যই তাঁর লেখায় কখনো জং ধরেনি, বরং পঞ্চাশেও দেখা গেছে স্বাভাবিক সুর পরিবর্তন।’

পঞ্চাশের দশক থেকে কবিতা লিখছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। প্রেম ও নারী তাঁর কবিতার মূল ভূমি। বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েও কবিতায় তিনি অপ্রতিরোধ্যভাবে রোমান্টিক। তবে তাঁর রোমান্টিকতা নিছক ভেসে যাওয়া নয়- তীর আছে, সীমানার শাসন আছে- থাকার আকুতি আছে।

আবু হেনার প্রকাশিত কাবগ্রন্থ- ‘আপন যৌবন বৈরী’ (১৯৭৪), যেহেতু জন্মান্ধ’ (১৯৮৪), ‘আক্রান্ত গজল’ (১৯৮৮)।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আবু হেনা মোস্তফা কামালের অবদান সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান যা বলেছেন তা স্মরণ না করে উপায় নেই। তিনি বলেছেন, ‘আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাদের সাহিত্য ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে, মূলত কবিতা ও গানের সম্ভার নিয়ে, তারপর মন দিয়েছিলেন একই সঙ্গে প্রবন্ধ ও সাহিত্য সমালোচনায়। তার ধী যেমন ছিল তীক্ষ্ন, তেমনি পাঠের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত। অল্প বয়সেই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নির্মাতাদের অনেকের বহু রচনাই তিনি পড়ে ফেলেছিলেন। তিরিশের ও তিরিশোত্তর বাংলা কবিতা তিনি পাঠ করেছিলেন সযত্নে, তার প্রভাব এড়াতে পারেননি, কিন্তু এ কথা ঠিক জেনেছিলেন যে, পাঠকের কাছে নিজের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দিতে হলে নিজের পথ নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। তার দুর্লভ সমালোচক সত্তা কেবল অন্যের ত্র“টি সন্ধানে ব্যাপৃত থাকেনি, নিজের রচনাকেও সেই মাপে ও মানে যাচাই করে নিতে প্রবৃত্তি দিয়েছিল তাকে।’

‘আক্রান্ত গজল’-এ তাঁর রোমান্টিকতা এমন একটা মাত্রায় উত্তীর্ণ হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কাব্য দুটোতে তেমনভাবে ছিল না। এখানে তাঁর কবিতা আরো আত্মস্বভাবী আরো প্রগাঢ়বোধসম্পন্ন। শব্দ ব্যবহারে, ছন্দ প্রয়োগে কাব্যশরীরে তিনি সঞ্চার করেছেন ‘গদ্য গুণ’, যা তিরিশ-উত্তর কবিরা চেয়েছিলেন। উত্তর-তিরিশের এই সাধনায় সফল হয়েছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

প্রেম ও বিচ্ছেদের বিচিত্র অনুভব নতুন রঙের আভায় রূপায়িত হতে দেখা গেল এ কাব্যে। প্রেমই প্রধান অনুষঙ্গ- এসব আবেগের তীব্রতায়- কী বুদ্ধির তীক্ষ্নতায়। সচেতনভাবে বুঝে শুনে পরিপূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ে ব্যক্ত করেছেন নিজের বক্তব্য-
অথচ এখন ফেরা অসম্ভব; পেছনে শুধুই বিসর্জন
সন্মুখেও ধূ ধূ শূন্য, মধ্যপথে তুমি অনায়াসে
কী করে ফেরাবে মুখ, অরুন্ধতী, মেঘে মেঘে সহিংস ঘর্ষণ
আদিগন্ত অন্ধকারে সর্বনাশ হয়ে নেমে আসে।’
(আমার সীমিত সাধ্য)

আবু হেনা মোস্তফা কামালের রচনাশৈলীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- জীবনঘনিষ্ঠ ব্যঙ্গমিশ্রিত সরস কবিতা। কৌতুক ও উপহাস কবিতায় জড়িয়ে দিয়ে তিনি কবিতাকে করে তুলেছেন আরো হৃদয়ঘনিষ্ঠ, বাস্তববোধসম্পন্ন। তাঁর জীবন দর্শন, জীবনবোধ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা তীক্ষè হয়। চিন্তা-চেতনায় শিরদাঁড়া খাড়া করা কবিতা- তার মধ্যেও স্নিগ্ধ স্বচ্ছ সাবলীল সহজবোধ্যতা পাঠককে মুগ্ধ করে, তারা উপলব্ধি করেন আবু হেনা মূলত প্রকাশ্য দিবালোকের কবি-কুয়াশা কুহেলি আচ্ছন্ন করেনি তাঁর চেতনাকে।

এই সহজবোধ্য চেতনা আরো সমৃদ্ধ করেছে তার সঙ্গীতকে। প্রকৃতি ও পরিবেশকে আপন অনুভবে সাজিয়ে তুলেছেন সঙ্গীতেও। অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয় গানের মধ্যে-
‘অনেক বৃষ্টি ঝরে/তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর/আমার দু’চোখ ভরে

সেই চম্পা নদীর তীরে/ দেখা হবে আবার যদি/ ফালগুন আসে গো ফিরে

হাতের কাঁকন ফেলেছি খুলে/কাজল নেই চোখে/তবু তোমার কাছে যাবো/যা বলে বলুক লোকে

‘আমি সাগরের নীল/নয়নে মেখেছি এই চৈতালি রাতে/ফুলকঙ্কন পরেছি দখিন হাতে

ভ্রমরের পাখনা যতদূরে যাক না ফুলের দেশে/তুমি তবু গান শুধু শোনাও এসে

নদীর মাঝি বলে, এসো নবীন/মাঠের কবি বলে, এসো নবীন/দেখেছি দূরে ঐ সোনালি দিন

ওই যে আকাশ নীল হলো আজ/সে শুধু তোমার প্রেমে

মহুয়ার মোহে গেল দিন যে/তোমার কাছে আমার কত ঋণ যে/সে কথা না হয় হলো নাই বলা/ ঝরা পাতার কান্না শুনে আজকে আমার পথ চলা

‘অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা/সেই থেকে শুরু দিন বদলের পালা

তুমি যে আমার কবিতা/আমার বাঁশির রাগিনী/আমারও স্বপন আধো জাগরণ/চিরদিন তোমারে চিনি

পথে যেতে দেখি আমি যারে

যায় যদি যাক প্রাণ/তবু দেবো না দেবো না দেবো না গোলার ধান

এই প্রথিবীর পান্থশালায় গাইতে গেলে গান

তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে/এই রাত এমন মধুর/তোমার হাসির রঙ লাগল বলে/দোলে ঐ মনের মুকুর

বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন প্রয়াত শিল্পী ও সুরকার আনোয়ারউদ্দিন খান এবং কবি, সঙ্গীতশিল্পী ও ক্রীড়াবিদ আসাফউদ্দৌলা। বন্ধু ছিলেন অকালপ্রয়াত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু বকর খান। এদের অনুপ্রেরণা তাঁকে সঙ্গীতমগ্ন করেছে। পরবর্তীকালে তাঁর অনেক গানে কণ্ঠ ও সুর দিয়েছেন আনোয়ারউদ্দিন খান। এছাড়া শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠেও তাঁর অনেক গান দারুণ সফল হয়ে উঠেছে। আবু হেনার গানের সুরকারদের মধ্যে আছেন আব্দুল আহাদ, কাদের জামেরী, আবেদ হোসেন খান, মশিহ-উল-আলম, আবু বকর খান, মীর কাসেম খান, মনসুর আহমেদ, শেখ মোহিতুল হক, খোন্দকার নূরুল আলম, শেখ সাদী খান, অজিত রায়, রাজা হোসেন খান, প্রণব ঘোষ, দেবু ভট্টাচার্য, অনুপ ভট্টাচার্য, সমর দাস, জালাল আহমেদ, সৈয়দ আনোয়ার মুফতী প্রমূখ। আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা অনেক গান তখনও যেমন রেডিও, টেলিভিশন ও গ্রামোফোনে শোনা যেত এখনও তেমন শোনা যায়।

কবি হিসেবে আবু হেনা মোস্তফা কামাল জাত রোমান্টিক। তাঁর গানগুলোও যেমন প্রেমের তেমন রোমান্সের। তীব্র অনুভূতিময় তাঁর কবিতাগুলো। জীবনবোধের সঙ্গে যৌবনের জলতরঙ্গের মিশ্রণ তার প্রতিটি কবিতাকে সজীবতা দান করেছে। জীবন্ত বৃক্ষের শরীরে যে রস, আবু হেনার প্রতিটি কবিতার অঙ্গনে ভায় তেমনি সজীবতা। মৃত কবিতা পড়তে কে ভালোবাসে? কবিতার মধ্যে হতাশার প্রহর গুনতে কে ভালোবাসে? রাজনীতির রাঙা লাঠি কি সব সময় ভালো লাগে? আবু হেনার কবিতা এর বিপরীত ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ; কেননা তা সাবলীল জীবন ও যৌবনের ঘ্রাণে বিকশিত।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না