সাজেদ রহমান : প্রেম ও বিরহের কবি

আলাউল হোসেন

মানবজীবনে প্রেম চিরন্তন বিষয়। প্রেম কখনো মানব-মানবীর একপাক্ষিক, কখনো দ্বিপাক্ষিক মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার সমষ্টি। এর বাইরেও সংসার জীবনে প্রেমের নানাবিধ রূপ আমরা দেখতে পাই। প্রেম কখনো কামতাড়িত, কখনো নিষ্কাম। কখনো মিলনাত্মক, কখনো বিরহকেন্দ্রিক। তবে ব্যক্তিগত প্রেম ছাড়াও বস্তুগত প্রেমের দৃষ্টান্তও পৃথিবীতে কম নাই। এরই ধারাবাহিকতায় কবিতায়ও প্রেম অনিবার্য এক সত্য হয়ে উঠেছে। সে সত্য কেবল কবিকেই আলোড়িত করে না, পাঠককেও যুক্ত করে। সেই সর্বব্যাপী প্রেম যেন ভর করে আছে কবি সাজেদ রহমানকে।

সাজেদ রহমানের কবিতার জগতে পদার্পণ ষাটের দশকে। কাব্যে কবি বন্দে আলী মিয়া সাহিত্য পুরস্কার, ‘অরণি পুরস্কার’, সাহিত্যে ‘কবিতা ক্লাব সাহিত্য পুরস্কার’ তাঁর উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি। এছাড়াও কেমব্রিজের ‘ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার তাঁকে আউটস্টাডিং পিপল অব দ্য টুয়েনটিথ সেঞ্চুরি’ এবং ইন্টারন্যাশনাল ম্যান অব দ্যা ইয়ার উপাধিতে ভূষিত করেছে। পেশাগত জীবনে তিনি সিভিল সার্জন অফিসে চাকরি করতেন। তাঁর জন্ম পাবনার কাচারীপাড়ায় ১৯ নভেম্বর ১৯৪৩ সালে এবং মৃত্যু ১ নভেম্বর ২০০৬ সালে।

যদিও সেই প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগে এসেও একচ্ছত্রভাবে বাংলা কবিতায় আধিপত্য বিস্তার করে আছে প্রেম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় মনোভাব, যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রথিবী, সামাজিক অবক্ষয়, মানসিক অস্থিরতা ও সমকালীন সমস্যার পাশাপাশি চিরকালীন মানবীয় প্রেম-বিরহও স্থান করে নিয়েছে কাব্যে। নিঃসঙ্গ কবির ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-দুর্দশাও কবিকে প্রেমের কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।

কবি সাজেদ রহমান সেই অর্থে প্রেমের কবি। তবে শুধু ব্যক্তিপ্রেমের কবিতাই নয়, সেখানে প্রস্ফুটিত হয়েছে বস্তুপ্রেমও। ‘তোমার নির্জন জলাশয় চোখ’র কবি সাজেদ রহমান আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তার কবিতা পাঠে কী এক অপার্থিব ভালোবাসায় আন্দোলিত হই আমরা। সংক্ষিপ্ত অথচ সাবলীল বয়ানে তিনি অসংখ্য প্রেমের কবিতা উপহার দিয়েছেন আমাদের। চিরকালের প্রেমকে বহুরৈখিক ব্যঞ্জনা দিতে তার তুলনা বিরল। জগতের তাবৎ বিষয়কে কবিতার বিষয় জানলেও প্রেমের কবিতা চিরকালই প্রতিপত্তিশালী। অথচ প্রতিপত্তিশালী প্রেমের কাছে তিনি ভীতু। কেননা রমনীর প্রতি ভালোবাসা কবিকে ভীত করে। কবি তাই বলেন:
দূরত্বের মলিন বিষণ্ণতায়
সম্পর্কের শেষ সূত্রটুকু মুছে গিয়ে
ইদানিং আমি যেন এক
নিঃসঙ্গ আইল্যান্ডে স্থবির ট্রাফিক।
দুহাতের অনুশাসনের
উপেক্ষার দূরন্ত সাহস নিয়ে
তোমার কপোলের চুনী টিপ
হারিয়ে গেছে
হৃদয়ের সর্পিল পথের বাঁকে
যুবতী এক হাল মডেলের গাড়ীর
সংকেত বাতির মতো।
(ইদানিং আমি)

এই ভয়কে জয় করতেই কবির ভালোবাসা আরও মরিয়া হয়ে আপ্রাণ। বিস্তৃতি লাভ করে শরীর থেকে আত্মায়। অজাগতিক প্রেম এসে জাগতিক টানাপড়েন নিমিষেই নিস্প্রভ করে দেয়-
জীবনের যাবতীয় ধূসর বিষণœতা কাটিয়ে
আমার প্রিয় সময়েরা কখন নিয়ে গেছে আমাকে
মন্ত্রমুগ্ধ জয়শ্রী জীবনের অপার বিস্ময়
শুধু একান্তে, শুধু তোমারই কাছে।
(মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিয়ে যায়)

আগেও বলেছি, কবির প্রেম কেবল মানবীর প্রতিই নয়। তার প্রেম সর্বজনীন। নারী, প্রকৃতি, কবিতাচর্চা, মূল্যবোধ সবকিছুর প্রতিই তার প্রেম চির জাগরুক। পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু যেন কবিতার কাছে তুচ্ছ। ভালোবাসার মানুষটির জন্য দুই ছত্র কবিতা-ই যথেষ্ট হতে পারে। বৈষয়িক আনন্দের চেয়ে অপার্থিব ভালোবাসা কোনও অংশেই কম নয়। কবি বলতে চেয়েছেন :
আমার কণ্ঠের শব্দ ভেঙ্গে দেয় ভোরবেলা স্বপ্ন তোমার
বুকের ওপর চেপে রাখে এক নিরেট পাথর
জটিলতায় ফুটিয়ে তোলে তোমার মন ও শরীর
রাতের মৌন ক্ষণগুলো ব্যর্থতার জিজ্ঞাসা বসিয়ে রাখে।
(ব্যর্থ রাত্রিবাসের কথকতা)

এ থেকেই বোঝা যায়, কবিতার প্রতি কবির ভালোবাসা কতটা গভীর। কতটা নিবেদিত প্রাণ তিনি কবিতার জন্য। পাশাপাশি প্রকৃতির প্রতি কবির ভালোবাসা অমোঘ। কেননা বাংলাদেশের অপরূপ মহিমা দু’চোখ ভরে দেখতে গিয়েও তিনি কবিতাকে সঙ্গে নিয়ে ফেরেন। একই কথা উচ্চকিত হয় তার অন্য কবিতায়:
পদ্মা-মেঘনা বহতা যমুনার কলতান
বয়ে যায় আমার সমগ্র শরীরে
ধমনীর খরস্রোতা রক্তে-দূর্বার প্রাণে
উদার আবৃত্তির উচ্চারণে
ত্রোস্তে-স্তবে-প্রার্থনায়
কখনও সোচ্চার এ দেশের অবিনাশী গানে।
(স্বদেশ এক অবিনাশী গান)

তার প্রেমের কাছে ধরা পড়ে নদীও। নদীমাতৃক এই দেশে নদীর প্রতি তার প্রেম আজন্মকালের। তার বেশির ভাগ কবিতায় আমরা নদীর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। কবি বলেন:
ভোরের প্রার্থনা সঙ্গীতের মতো
সত্ত্বার অববাহিকায় যেন এক
স্বপ্নের প্রিয় নদী
হিরন্ময় পূত উচ্চারণে বয়ে যায়
বয়ে যায় নিরবধি।
(স্বপ্নের প্রিয় নদী)

বস্তুগত পৃথিবীর বাসিন্দাই তার প্রেম রূপায়ণের অনিবার্য উপকরণ। আমাদের মতো রক্ত-মাংসে গড়া মানুষের যাপিত জীবন ও প্রকৃতিতে তার কাব্যভাষা প্রয়োগ আমাদের কাছে সর্বত্রগামী মনে হয়। প্রেম ও নিসর্গের এই তাত্ত্বিক সংযোগ রয়েছে তাঁর কবিতায়। ফলে এর বাস্তব প্রতিফলনও ঘটেছে তার কাব্যে। তবে তার বর্ণনা কখনো গতানুগতিক ধারায় হয়নি বরং বৈচিত্র্যময় এবং ক্রমেই তা নতুন নতুন পথে এগিয়েছে।
এখানে আমার আয়ুতে যত্রতত্র বিষাক্ত ছত্রাক
এখানে কালহীনতায় অনন্ত আরণ্যক কান্না
হে ইচ্ছের বিধাতা, তোমার কাছে
করুণার বাহু উর্ধে তুলে মিনতি আমার
ফিরিয়ে নাও পুনশ্চ আমাকে একবার সূচীত বাৎসল্যে
আমি আমার নতুন করে পড়তে শিখি
(মৃত্যুহীন সূর্যের সন্ধানে)

এছাড়া আমরা দেখি, প্রেম ও নিসর্গের মিলন কবির স্বাতন্ত্র্যকেই উচ্চকিত করে। নৈসর্গিক শব্দের ব্যবহারে তার প্রেম চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। জাগতিক সব প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হলেও কবি ফেলে আসা অতীতের কাছে ফিরে প্রশান্তি খোঁজেন। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সবই স্বাভাবিক চললেও শুধু তার প্রেম নেই যেন আগের মতো। প্রেম-বিরহে কাতর কবি শুনতে পান তার স্মৃতিধ্বনি যার সঙ্গী এখন অন্যজন। তাই তো কবি বলেন :
বনজোছনায় স্নানের কথা ছিলো দুজনে
লজ্জায়-অলজ্জায় প্রেম নিবেদনে।
অবশেষে যখন তুমি এসে দাঁড়ালে
অরূপ চাঁদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে।
(অবশেষে)

কবিতার বিষয় নির্বাচনে, দৃশ্যকল্প নির্মাণে তার উপমাগুলো সার্থক হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে প্রেমময়। কখনো কখনো তার শিরোনামগুলোই একেকটা কবিতা হয়ে ওঠে।
১. তোমাকে জাগাবো না আজ রাতে
২. চেনা অচেনার পথে
৩. কবিতার এই হাত
৪. ছুঁয়ে দেখ সোনালী হাতে
৫. একটি বাজেয়াপ্ত কবিতা
৬. প্রিয় শব্দ প্রিয় পঙক্তিমালা
৭. হৃদয়ের সনির্বন্ধ ভাষা
৮. তোমার নির্জন জলাশয় চোখে
৯. যেতে যেতে ফিরে আসি
১০. অতিক্রমের সময় নেই

এ রকম বহু শিরোনাম রয়েছে তার কবিতার, যা কবিতাটি পাঠ করতে পাঠককে উদ্বুব্ধ করবে। মূলত বৃহদার্থে তার প্রেমের কবিতার বিশ্লেষণ ক্ষুদ্র বাক্যব্যয়ে কখনোই সম্ভব নয়। তার সারাজীবনের লিখিত আবেদন ক্ষণিকেই হৃদয়স্থ করা কিঞ্চিৎ দুরূহ বটে। দীর্ঘ পঠন-পাঠনই তার প্রেমকে আমাদের সামনে প্রজ্জ্বলিত করে।

সাজেদ রহমানের কবিতায় পর্ববিন্যাস চমৎকার আবহ তৈরি করে। ছন্দ, তাল, লয় নতুন আবেশ এনে দেয়। তার কবিতার সার্থকতা এখানেই। শব্দের পর শব্দ টেনে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়; পাঠক হয়ে ওঠেন কবিতাগ্রস্ত। তার কবিতার ছন্দে ছন্দে যে সুর বেজে ওঠে, অন্ত্যমিলেও তার রেশ রয়ে যায়। কী এক ব্যাকুল তৃষ্ণা জেগে ওঠে কবিমনে। যা পাঠককেও আন্দোলিত করে। কবি বলেন:
নির্জন তরল রাত নামুক এবার
জীবন-বৃন্তে পাখা মেলো কামনা-কুসুম
এই তো স্বচ্ছন্দ সময় ঘর বাঁধবার
প্রভাকীট হয়ে থাক আমাদের ঘুম।
(বৃষ্টি এসো মনে)

কবিতার এই আকুলতা পাঠকের আকাক্সক্ষাও বাড়িয়ে তোলে। যেন তার কবিতারই উপমা। কবিতায় মাধুর্যই যদি না থাকে তাহলে পঙক্তিতে লাবণ্য আসবে কোথা থেকে? ছন্দসচেতন কবি ব্যবহৃত সব ছন্দের উত্তম ব্যবহারই করেছেন। মুক্তক ছন্দেও কাব্য রচনা করে তথাকথিত ছন্দবিরোধীদের বুঝিয়ে দিয়েছেন ছন্দ সর্বকালেই পূজনীয়।
একদিন পুড়েছিলাম তোমার শরীরে আগুনে
কোন এক অনিবার্য পাপে
এখনও জ্বলছি সে আগুনে অহরহ
দুর্বাসার নির্ধারিত অভিশাপে।
(আগুনের কষ্টিপাথর)

কবি তার কবিতাকেও যেন বিভিন্ন অঙ্গে রূপ দান করেন। একটি কবিতা থেকে অন্য কবিতা আরো বেশি সুনির্মাণের দিকে ধাবিত হয়। এভাবে বানাতে বানাতেই তিনি হয়ে ওঠেন সার্থক প্রেমের কবি। ব্যক্তির সারল্য, শিশুমনের প্রেম, তীব্র অভিমান, চারিত্রিক অহংবোধ কবিকে চিরকালীন বিশিষ্টতা দান করে। পাঠক তার ভালোবাসার বিশাল সমুদ্রে অবগাহন করে কুড়িয়ে আনবেন মহামূল্যবান মণি-মুক্তা এমন প্রত্যাশা করি।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না