গোবিন্দলাল হালদারের কবিতার নির্যাস ও রসতত্ত্ব

আলাউল হোসেন

প্রেম ও যন্ত্রণা থেকে কবিতার উৎপত্তি। গোবিন্দলাল হালদার একজন উদীয়মান তরুণ কবি, প্রেমিক কবি। কবির কবিতায় প্রেমকথন অতি নিখুঁতভাবে দেখা যায়। হয়তো কবি জানেন, অখণ্ডের সঙ্গে ভাববন্ধনই প্রেম। আর এ জন্যই কবি তার কবিতায় প্রেমকে দর্শনরূপে জাগতিক ও ঐশ্বরিক এই দ্বিবিধ সূত্রে গ্রন্থিত করেছেন। কবির ভাষায়-
প্রকাশের ইচ্ছায় সে অনন্তকাল
নিজের পরিমণ্ডলে
কাঠ খড়ি না পুড়িয়ে
বায়ু মাটি জল অনলে
নিজ ঘরের আলো দিল
আলো নিয়ে দাঁড়ালে…
(ভেবে দেখো : প্রাচীনতত্ত্ব)

কবি গোবিন্দলাল হালদার ঐশ্বরিক ও মানবপ্রেমকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রাধান্য দিয়েছেন। মানব দেহ পঞ্চভূতে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুং, বোম) তৈরি। কবি তার কবিতায় বায়ু, মাটি, জল ও আলোÑ এই পঞ্চভূতের কথাই বলেছেন। পৃথিবী এখন স্নায়ুযুদ্ধে মহড়ারত। পৃথিবীতে প্রেমের বড় অভাব। প্রেমের ক্লান্তিলগ্নে কবি গোবিন্দলাল হালদার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এখন প্রেমহীন মানুষ তাদের প্রকৃত গন্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণ আর নিজেদের মধ্যে ছেঁড়াছিঁড়ি খেলায় লিপ্ত। তাই কবি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-
ছেড়াছিঁড়ি খেলা
সহজাত প্রবৃত্তি
মানুষের আদিম অভ্যেস
………………………..
আজ ছেঁড়ার হিসেব
মিলাতে হিমশিম খাই
চমকে উঠি।
(মানুষের আদিম অভ্যেস)

শুদ্ধ প্রেম মানুষকে চিন্তা চেতনায় অনুপ্রাণিত করে। মানুষ শুদ্ধ প্রেমের পরশে ভুলে যায় উঁচু-নিচু, হিংসাদ্বেষ নামক অপসংস্কৃতি। তাই কবি গোবিন্দলাল হালদার কবিতার আহ্বানে মানুষে মানুষে সেতুবন্ধন গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকা যখন তাদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বে বিচ্ছেদের নীল নীল প্রহর গোনে, তখন কবি মর্মাহত হন। কবি প্রেমিক-প্রেমিকার সেই বিচ্ছেদ বেদনা কবিতার ভাষায় লিখেছেন-
ক্ষয়ে যাচ্ছে দুয়ে এক হবার সম্পর্ক
বিবাদী বৈপরীত্যের দাঁতাল দংশনে
তাই তৃষ্ণার্ত মনে বয় ভীষণ খরা
পাথর পরান দেশে, জানি না কী হয়
কেমন থাকতে পারি, উচ্চ রক্তচাপে।
(পাথর পরান দেশে)

প্রেম মানুষকে অতুল ঐশ্বর্য দেয়। প্রেমের আঁধার মানুষের শুদ্ধমন। প্রেম মানুষকে যন্ত্রণা দিতে পারে না। যদি যন্ত্রণা দেয়, তা প্রেমিক প্রেমিকাকে কিংবা প্রেমিকা তার প্রেমিককে। সেই সাথে সামাজিক পরিস্থিতির আর্দ্র কষ্টগুলো অনেকাংশে সম্পৃক্ত। কবি গোবিন্দলাল হালদারের কবিতার পংক্তিতে-
আর্দ্র কষ্টগুলো
কিসমিসের দেহে ডুব দেয়
যখন গভীর থেকে সুগভীরে
করুণাময়ী দুই নারী তখন কাঁদে
ঝর্ণাধারা নামে গরম গরম জল কণায়।
(অনুভূতির চুলোয় আগুন)

অন্তরের মায়াপুরে প্রেম থাকে। অনুভূতির ঘারানায় প্রেম চলাফেরা করে। আর হৃদয় নামক অনুভূতির সত্ত্বাকে শুধু একজনকেই দান করা যায়। দ্বিতীয় কোন প্রেমিকের আশা করার অপর নাম নস্টালজিক। তাই কবি বলেছেন-
কড়কড়ে অনুভূতির মাঠে
দ্বিতীয় চাষের প্রয়োজন নেই
প্রয়োজন নেই পিছু হাঁটা ফুরফুরে সংগোমে
উইপোকার দাঁতের সামনে… কামড়ে… রক্তপাতে
প্রয়োজন নেই নকল কাঁথার গুম।
(নকল কাঁথার গুম)

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে সঙ্গীহীন মানুষ সম্পূর্ণ অসহায়। প্রিয়জনের সান্নিধ্য কামনা সকলের অন্তরেই আছে। অথচ মানুষ তিল পরিমাণ ভুলকে বড় করে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। আপনজনকে ভুলে যায়। অহিংসা পরম ধর্মÑ এই নীতিবাক্য স্মরণ না করে অন্তরটিপুনীতে অগ্রসর হয়। সেই অন্তঃসারশূন্য পরিস্থিতিকে কবি গোবিন্দলাল হালদার তাঁর কবিতায় প্রকাশ করেছেন এই ভাবে-
ভুল বনের নীলকাঁটা
অন্ধকারেও বেড়িবাঁধ ভাঙে
সন্তর্পনে এসে দাঁড়ায়, ঘন ঘন কড়া নাড়ে
ভেতরে যায়, হৃৎপিণ্ডের আঁচড় কাঁটে এবং
ফুসফুসের মাটিতে পুঁতে দেয়
ঈর্ষার তল্লা বাঁশ।
(আত্মহনন ও ঘোড়ারোগ)

প্রেম ভালোবাসাহীন মানুষ বাঁচতে পারে না। কবি গোবিন্দলাল হালদার মানুষের মাঝে প্রেমের নিদর্শন দেখতে পেয়েছেন-
তুমি প্রেম
তুমি মানিক মুক্তা প্রেম।
(তুমি বিষয়ক উপস্থাপন)

কবি সেই পবিত্র প্রেম দেখতে পেয়েছেন। তাই মানুষের হৃদয়কে পরিত্র স্থান হিসেবে কবি শ্রদ্ধা করেন। মানুষের কাছে কবি প্রেমের কাঙ্গাল, প্রেমের ভিক্ষুক। তাই মানুষের দ্বারে দ্বারে প্রেম চেয়ে বলেছেন-
আমাকে প্রেম দাও, প্রেম
অখণ্ড প্রেম, স্বর্গীয় প্রেম,
চিরায়ত, চির শাশ্বত প্রেম।
(অনাহুত বৃত্তের কেন্দ্র)

ও শ্বেতাঙ্গ, সে কৃষ্ণাঙ্গ- এটা শুধু বাহ্যিক রূপ। ছান্দসিক কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন- ‘কালো আর ধলা বাহিরে কেবল ভিতরে সবার সমান রাঙা’। আসলে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। “অষষ সবহ ধৎব বয়ঁধষ নু নড়হব” -সকল মানুষই এক ঈশ্বরের সৃষ্টি। মানুষের ধর্মের নাম- মানবধর্ম। মানুষকে ভালোবাসলেই ঈশ্বরকে ভালোবাসা হয়। সকল বিভেদ-বৈষম্য ভুলে সম্প্রীতির জয়গান গেয়েছেন কবি গোবিন্দলাল হালদারও তার টুকরো পংক্তিমালায়-
রূপে ভিন্ন মূলে একই
দ্যাখ্যায় দৃষ্টি ভ্রম;
যে যেমন দেখি।
(অন্তর্দৃষ্টি)

প্রেমিক কবি গোবিন্দলাল হালদারের প্রেম বিষয়ক কবিতা পড়লে ঈশ্বর প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করতে ইচ্ছে হয়। কবি তার কবিতায় আধ্যাত্মিক বিষয়ও সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেছেন-
ও ভেতরে বসে রাজত্ব করে
ও ভেতরে গিয়ে আপনি মরে।
(ও)

ষড় রিপুর যন্ত্রণায় মানুষ প্রেমকে ভুলে গিয়ে বিবেকের তাড়নায় দংশিত হয়। কামে বশীভূত হয়। আর এভাবেই ঈশ্বর প্রেম থেকে মানুষ নস্টালজিক অভিব্যক্তিত্বে মিশে সত্যানুসন্ধান থেকে দূরে… বহুদূরে- অন্ধকারে ডুবে হাবুডুবু খায়। হারায় সত্য- সঠিক পথ। সৃষ্টিকর্তার কথা পথভ্রষ্ট মানুষ বেমালুম ভুলে যায়। কবি সেই পথহারা বঞ্চিত মানুষদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-
এখনো তুমি
ফিরে নাওনি মহাকাব্যের সূর্য
এখনো উদিত হয়
উর্বর মাটির অলৌকিক উদরে
হেঁটে বেড়ায় প্রতিমুহূর্তে
এ বাড়ি- ও বাড়ি।
(মহাকাব্যের সূর্য)

সংস্কৃত আলঙ্কারিক বলেছেন- কাব্যং রসাত্মকং বাক্যং। কবি গোবিন্দলার হালদারের প্রেমের কবিতায় সেই রসতত্ত্বের নির্যাস পাওয়া যায়। তিনি সময়ের ফসল। তিনি সময়ের সাথে ভালো আলাপ জমাতে পারেন। সে জন্যে তার কবিতারও জন্ম সময়ের পাঁজর থেকেই। ইদানীং কালের সব কবিদের মতো গোবিন্দলার হালদারও বুঝেছেন, নিজের কথা নিজের মতো করে বলতে হবে। এভাবেই আসে সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা। কবির নিজের ভাষায়-
সময়ের ডালপালা ভেঙে
ধস নেমেছে আমার পৃথিবী
সূঁচকের পঁচা আঠার আকর্ষণে
এখন প্রদেয় সম্পদ তোমার কাছে
অনাগত প্রজন্ম।
(দর্শন ঘুড়ি)

কবিরা সারা জীবন দুয়ার খুলেই বসে থাকেন। তারা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো দুয়ার এটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া’র মতো নন। কিন্তু কবিদের ওই খোলা দুয়ারের সন্ধান সকলেই নিতে চান না। কবি গোবিন্দলালের বেলাতেও তাই। তথাপি কবি গোবিন্দলার হালদার বিপরীত স্রোতে মিশে যাননি। আছেন শুদ্ধ স্রোতে। আছেন জীবনের পক্ষে। তিনি জীবনের পক্ষে আছেন বলেই এমন কথা বলতে পেরেছেন।
বিপরীত জলে শব্দের মাত্রা
বিপরীত ইন্দ্রজাল, জটিলতত্ত্ব
তবুও জীবন চলমান।

চলমান জীবনে চলতে চলতে কবি আধুনিক বিশ্বের নানাবিধ সমস্যার কথাও মাথায় রাখেন। আশ্চর্য হতে হয়, কবির নারীচেতনাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দিকে তাকালে। পুরুষ শাসিত সমাজে অনেক পুরুষ সাহিত্যিক আজও বুঝে ওঠেন কিনা সন্দেহ যে, মেয়েরা আজও অবহেলিত এবং পুরুষের বঞ্চনার স্বীকার। এমন বিশ্বাস যারা করেন না, তাদের অনুভূতির চুলোয় আগুন দিতে চেয়েছেন কবি গোবিন্দলাল হালদার-
সংসার প্রেয়সী এসেছিল
সেই অনেকদিন আগে-
অনুভূতির চলোয় আগুন দিয়ে
বেচারী চলে গ্যাছে
এখন স্বামীর কষ্ট।

সংসারে এমন নারী কতই তো চলে যাচ্ছে। কিন্ত কবি গোবিন্দলাল হালদারের মতো এত স্বচ্ছতর সাহসিকতার সঙ্গে কজন খবর রাখেন? নারী চেতনাবাদকে এক নব্য পাঠকৃতিতে পৌঁছে দিতে চান কবি।

কবি গোবিন্দলার হালদারের কবিতার নামকরণগুলো বড় বেশি অদ্ভুত রকমের। কবিতার নামকরণ দেখেই সহজে চেনা যায় এটা তার কবিতা। যেমন- ‘দূরালোকের আধুনিক কবিতা’, ‘পৃথিবী বুক পকেটে’, ‘নোনতা জল এবং উত্তরাধুনিকতা’, ‘দৌড় বৃক্ষের শাখা’, ‘আত্মহনন এবং ঘোড়া রোগ’, ‘স্বর্ণাপ্রতীক এবং আদিপিতা’, ‘উকুন, উদাহরণ এবং প্রেক্ষাপট’ প্রভৃতি।
পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার চরপাড়া গ্রামে ১৯৬৬ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জিতেন্দ্রনাথ হালদার একজন স্বভাবকবি। পিতার কাব্যচর্চা দেখে শিক্ষাজীবন থেকেই তিনি কাব্যচর্চা করে আসছেন, তিনি এ দেশের জাতীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন লিটলম্যাগে এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত ছড়া, কবিতা লিখছেন। পেশাগত জীবনে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি কবিতা, ছড়া, গান, নাটক, সাহিত্য আলোচনা ইত্যাদি বিষয়ে লেখালেখি করেন। প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি উত্তরণ সাহিত্য পুরস্কার, নবোদয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘জলযুদ্ধ’ প্রায় এক যুগ ধরে প্রকাশিত হচ্ছে।

কবি গোবিন্দলাল হালদার যেন তার ‘আমি প্রার্থনায় মগ্ন হবো’ কবিতার মতোই প্রার্থনা করুক কবিতার। পাঠক সময়ের তপ্ত বেলচায় তুলে নেবে কবির কবিতার অন্তঃস্বর।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না