জিয়া হায়দার : নাটক-কবিতার প্রাজ্ঞজন

আলাউল হোসেন

জিয়া হায়দার এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার জন্য আসলে বিশেষণ পর্যাপ্ত নয়। তিনি একজন লেখক, কবি, নাট্যকার, অনুবাদক ও অধ্যাপক। তার পুরো নাম শেখ ফয়সাল আব্দুর রউফ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার। তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস (বিটা)-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৭টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি নাটক লিখেছেন এবং বেশ কিছু নাটক অনুবাদ করেছেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত হন।

তার জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বর পাবনা জেলার দোহারপাড়া গ্রামে। পারিবারিকভাবে জিয়া হায়দারদের পরিবার ছিল বিশাল ভূ-সম্পদের অধিকারী। তার বাবা সেই জমি-জমা দেখতেন। আর ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। মূলত পরিবারটি ছিল সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার। তার মা ছিলেন গৃহিণী। মাত্র ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই বিদ্যা নিয়েই তিনি শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’, এমনকি ‘গোরা’র মতো কঠিন উপন্যাসও বানান করে করে পড়ে ফেলেছিলেন। হায়দার পরিবারের ছেলেদের কপালে ‘সাহিত্যিক’ অভিধা জোটার পেছনে এই মাতৃদেবীর ভূমিকা ছিল অনেকখানি। হাকিমউদ্দিন শেখ আর রহিমা খাতুনের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। জিয়া হায়দার সর্বজ্যেষ্ঠ। ডাক নাম রউফ। বাড়ির ছোটরা তাকে আদর করে ‘সোনাভাই’ বলে ডাকতেন।

সেকালে অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সন্তান হলে তার কুষ্টি লিখে রাখা হত। কুষ্টি মানে যাতে সন্তানের ভূত-ভবিষ্যত লেখা থাকে। জন্মের ক্ষণের সাথে মিলিয়ে পণ্ডিত বা আলেমরা এই কুষ্টি লিখে দিতেন। কুষ্টির কথা কতটুকু ফলত তা নিয়ে মনে হয় লোকে খুব একটা মাথা ঘামাত না। একটা গোল করে গোঁটানো লম্বা কাগজে বাঁকা-বাঁকা প্রাচীন ধাঁচের হাতের লেখায় কী সব হাবিজাবি লেখা হত এবং সেটি বাড়ির দেয়ালের গায়ে লাগানো কাঠের তাকে যতœ করে তুলে রাখা হত, আর এটিই হল সেই কুষ্টি। নাট্যজন ও কবি জিয়া হায়দারের এরকম একটা কুষ্টি ছিল। তাতে কী লেখা ছিল তা জানা যায়নি।

জিয়া হায়দারের লেখাপড়ার শুরু তার বাবারই প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাথমিক স্কুলে। নাম আরিফপুর প্রাথমিক স্কুল। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। পরে চলে যান পাবনা জেলা স্কুলে। সেখানে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর গোপালচন্দ্র ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন জিয়া হায়দার। ১৯৫৬ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর জিয়া হায়দার ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৮ সালে তিনি সেখান থেকে বাংলায় অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর কিছুদিন কাজ করেন তখনকার জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘চিত্রালি’-তে। মাস্টার্সের ফল বেরুবার আগেই অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যান তোলারাম কলেজে। যাবার সময় নিজের চাকরিটা দিয়ে যান ছোট ভাই রশীদ হায়দারকে। নিজের লেখালেখির জগত, চাকরি আর পরিবারের ছোট ভাই-বোনদের মানুষ করার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। এর মাঝে কিছুদিন কাজ করেন বাংলা একাডেমিতে। তারপরে পাকিস্তান টেলিভিশনে। টেলিভিশন ভবন তখন ছিল ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক ভবন)। ১৯৬৮ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। পরে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ার থিয়েটার’ ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়া হায়দার যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। সেখান থেকেই অবসর নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় এবং পরে এশিয়া ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা প্রথিবী চষে বেরিয়েছেন নাটকের প্রয়োজনে। বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বের নামি-দামি নাট্যজনদের সাথে। “কৌটোর ইচ্ছেগুলো”, “আমার পলাতক ছায়া”, “এলেবেলে”, “নাট্য ও নাটক”, “বাংলাদেশের থিয়েটার ও অন্যান্য রচনা” ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

১৯৭৫ সালের ২৩ জুন এক অধ্যাপিকাকে বিয়ে করেন। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। কারণ অধ্যাপিকা ছিলেন সিজনাল মানসিক রোগী। সেটা বিয়ের পর ধরা পরে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না জিয়া হায়দারের। চিকিৎসার সব রকম চেষ্টাই করেন তিনি। অবশেষে সেই সংসার ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে বিয়ের সেই তারিখ আর নিজের বিড়ম্বিত ভাগ্য নিয়ে রসিকতা করে বলতেন, ‘১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল।’

শেষ জীবনে এসে আক্রান্ত হন মরণব্যাধি ক্যান্সারে। ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন নাট্যজন জিয়া হায়দার। তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় জন্মস্থান পাবনার দোহারপাড়ার আরিফপুর গোরস্থানে।

নাটকের প্রতি তার পয়লা প্রেম হলেও কবিতায়ও সিদ্ধহস্ত। জিয়া হায়দারের নাটক শুভ্রা সুন্দর কল্যানী আনন্দ এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু ঐ নাটকের এবং নাট্যকারের অন্বিষ্টের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে তার কবিতা ‘কৌটোর ইচ্ছেগুলো’র এই অংশ থেকে:
জানিস, তখন আমি বারো বছরের
সংসারের বড়ো বউ, নিজ হাতে লাগিয়েছিলাম,
কিন্তু ফুল দেয়নি কোনো সকালেই;
তা সেই বিষ্টির পর ভোরে ফুল ফুটলে তুই
আমার করবে রেখে আসবি, শিয়রের দিকে;
সে সময় খুব ফসল উঠবে, ইচ্ছে মতো গান করিস, দোহারে
ধুয়ো ধরিস, বাঁশির গান
আর সে সময়ই কিন্তু আমার ছোটকাকুর বিয়ে দিবি
নতুন বউমাকে বলবি নিজ হাতে উঠোনটা নিকোতে
তারপর উঠোনের দাওয়ায় আলপনা কাটতে
তাতে যেন অবশ্যই ধানশীষ আর পায়রা থাকে।
ওই যে বললাম, কোরাণশরীফ, পানবাটা
এগুলো বউমাকে দিবি।
………………………………………..
………………………………………..
আর শোন, এতক্ষণ বলাই হয়নি,
আমার মাথার নিচে একটা কৌটো আছে,
সেটাও বউমাকে দিবি
জানিস ওতে কী আছে
আমার কয়েক টুকরো ইচ্ছে-
ফুল, বিষ্টি, পায়রা, ধানশীষ, গান;

জিয়া হায়দারের কবিতায় বাঙালি চেতনার সমস্ত অবয়ব যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের কবিতার অবিতায় বাঙালি চেতনার সমস্ত অবয়ব প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের কবিতার অন্তর জুড়ে সঞ্চারিত হয়েছে তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে নানান অনুষঙ্গ রূপ পেয়েছে কবিতায়। কবিতার শরীর ও ধমনীতে সঞ্চারিত হয়েছে তীব্রতা, ক্ষোভ, আর্তি ও বেদনার স্বপ্ন গাঁথা।

তাঁর কাব্যে যেসব ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো প্রবল ইন্দ্রীয় চেতনা; প্রকৃতি ও নারীর সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ।’ তবুও মানব জীবন তার সময় ও সমাজ-রাষ্ট্রের ভাঙাগড়ার দুমদাম শব্দ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; তাঁর কবিতাবলিতে এর আভাস তীক্ষèভাবেই আঁচ করা যায়।

জিয়া হায়দারের কাব্যে রোমান্টিকতা অফুরন্ত কিন্তু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করা যাবে ধীরে ধীরে সমাজ ও সমকালীন চেতনাও তার কবিতায় শিরা-উপশিরার মতো কাজ করেছে।

জিয়া হায়দার প্রেরণার জন্য শুধু মেঘ কিংবা নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টি রাখেন না, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থমালার প্রতিও গভীর মনোনিবেশ করেন। নিজের অন্তর্দৃষ্টি, প্রচুর পাঠ, সর্বোপরি জীবন-নিংড়ানো অভিজ্ঞতা জিয়া হায়দারের কবিতাকে সমৃদ্ধ এবং অগ্রসর করে তুলেছে।
কথা বলতে বলতে, প্রসংগ-অপ্রসংগে, এলোমেলো
‘কথা, অধিকাংশই যদিও প্রেমের, স্বর্গীয় আদপে নয়,
যেন বেখেয়ালী, অথচ রাস্তার ধূলো বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে,
শাড়িতে অজস্র চোরকাঁটা নিয়ে বসবে ওরা সামনের সারিতে,
অতঃপর প্রচুর আলোর প্রান্তরে
বিভিন্ন শরীরে সংলগ্ন-আনন্দের অন্ধকার হবে;
বেলা পড়ে গেল- না, না, ওরা কেউ জলকে যাবে না।
(বেলা পড়ে গেলে)

কেবল স্বজাতি-স্বদেশ নয়, বৈশ্বিক চেতনাও তার কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি জানতেন এবং মানতেন উগ্র জাতীয়তাবোধ কবিকে সংকীর্ণ ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ রাখে। আবার দেশপ্রেমহীন বিশ্বনাগরিকবোধও কবিকে উন্মুল ও উদ্বাস্তু করে তুলেছেন। শেকড়বিহীন বৃক্ষ যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, তেমনি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ব্যতীত কবিরও অস্তিত্ব বিপন্ন। কারণ, ভূখণ্ড ব্যতীত যেমন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না, তেমনি সার্বভৌম কবির অস্তিত্বও। প্রত্যেক সার্বভৌম কবিরই একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকে। সেটিই তার শেকড়। শেকড় যে প্রাণসঞ্জিবনী গ্রহণ করে, তা তার নিজের ভূখণ্ড থেকেই।

তবে এ কথা অস্বীকার করা যায়ই না বুদ্ধির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির প্রাখর্যেই তার সৃষ্টি উজ্জ্বল। কবিমনের অহংপ্রবণতা, কবিতাকে মানবজাতির চিৎপ্রকর্ষ ও চরিত্র প্রকাশের অনুষঙ্গে পরিণত করে।

কবি জিয়া হায়দারের একটি বিখ্যাত কবিতার উদ্ধৃতি করছি শেষে। কবিতাটির নাম, রবীন্দ্রনাথ। কবি লিখেছেন, ‘ক্ষমা করো অজ্ঞাতেই, যেহেতু জেনেছি আমার অস্তিত্বে তুমি ঈশ্বরের মতো।’

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না