আলাউল হোসেন
শফিক নহোর সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে একজন জনপ্রিয় গল্পকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতা নিয়মিতভাবে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মায়াকুসুম’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যার পর প্রকাশিত হয় ‘বিষফুল’। এছাড়া, বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা এবং অনলাইন সৃজনশীল ওয়েবম্যাগগুলোতে তিনি নিয়মিত লিখে থাকেন। সৃজনশীল ওয়েবম্যাগ কাব্যশীলনের সাব-এডিটর হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন, যা সাহিত্য জগতে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অঙ্গীকারের প্রমাণ। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: ‘কবিতা কানন’ (যৌথ কাব্যগ্রন্থ), ‘প্রাণের পড়শি’ (যৌথ কাব্যগ্রন্থ), ‘প্রাণের পড়শী-২’ (যৌথ কাব্যগ্রন্থ), এবং কাব্যগ্রন্থ ‘মিনফুলের ঘ্রাণ’। এই বৈচিত্র্যময় প্রকাশনা তাঁর সাহিত্যিক পরিধি এবং সৃজনশীলতার গভীরতা নির্দেশ করে।
শফিক নহোরের জন্ম বাংলাদেশের একটি মফস্বল এলাকায়, যেখানে কৃষ্ণচূড়া ফুটে, কুয়া মরে যায়, নদী হারিয়ে ফেলে স্রোত। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতার শরীরে অনবরত বয়ে চলে। গ্রামের কুয়া থেকে মহানগরের শেয়ারবাজার, অথবা আদুরী আঙুল থেকে কর্পোরেট ভোগবাদের নগ্নতা — সবই তাঁর কবিতার রক্ত-মাংস।
১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম শেখ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মো. আব্দুল মাজেদ শেখ এবং মাতা মরহুমা হামেদা খাতুন। বারো ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। পারিবারিক জীবনে ২০১০ সালে সুমি খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের দুই কন্যা সন্তান, শেখ ইসলাম লামহা ও শেখ আরবী জান্নাত। ব্যক্তিগত জীবনের এই গভীরতা তাঁর কাব্যে এক সংবেদনশীলতার জন্ম দিয়েছে, যা তাঁর লেখায় পারিবারিক সম্পর্ক ও মানবিক অনুভূতির এক সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। বর্তমানে তিনি নাসির গ্লাস ওয়্যার এন্ড টিউব ইন্ডা. লি. এর আইটি বিভাগে সহকারী ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত আছেন।
শফিক নহোরের কবিতাগুলি তার নিজস্ব জীবনদর্শন, সমাজের প্রতি পর্যবেক্ষণ এবং সংবেদনশীলতার এক অসাধারণ মিশ্রণ। তাঁর কবিতায় তিনি প্রেম, বিচ্ছেদ, সামাজিক বৈষম্য, প্রকৃতি এবং মানব মনের গভীরে লুকানো অনুভূতির অনুসন্ধান করেন। তার ভাষা সহজ, সরল কিন্তু গভীর অর্থবোধক, যা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে। রূপক, উপমা এবং প্রতীকী চিত্রকল্পের ব্যবহার তার কবিতাকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। তাঁর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তবের কঠিন চিত্র এবং স্বপ্নময় কল্পনার সংমিশ্রণ; যেন এক একটি ক্ষুদ্র ক্যানভাস, যেখানে তিনি তুলির টানে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের বিচিত্র রঙ।
শফিক নহোরের কবিতা আমাদের বর্তমানের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে প্রগতির পক্ষে এক প্রচণ্ড উচ্চারণ। কখনো প্রেমিক, কখনো যোদ্ধা, আবার কখনো মৃদু দীর্ঘশ্বাসে হারিয়ে যাওয়া কবি হিসেবে তিনি আমাদের সময়ের দর্পণ হয়ে উঠেছেন। তাঁর কবিতা কেবল পাঠ্য নয়, চেতনারও এক সজীব মাধ্যম; কাব্যময় ও দৃঢ়চেতা, যা পাঠককে ভাবায়, জাগায় এবং বদলাতে শেখায়।
এ প্রবন্ধে তাঁর কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো।
নারী: প্রেম, নিপীড়ন ও প্রতিরোধ
নারী তাঁর কবিতায় একধারে প্রেমিকা, অন্যদিকে নির্যাতিতা, আবার কখনো যোদ্ধা।
‘কচি শরীর’ কবিতায় তিনি বলেন:
“পোড়ো না হলে পোড়াও কচি শরীর—
ঢের কদর বেড়েছে বিজ্ঞাপনে নারীর শরীর।”
এখানে দেখা যায় নারীর শরীর কেবলই ভোগের পণ্য নয়, বরং প্রতারণার প্রতীক।
তেমনি ‘আদুরী আঙ্গুল’ কবিতায় নারী সংসারী হয়ে ওঠে, কিন্তু হৃদয়ের ক্ষতরেখা স্পষ্ট:
“তোমার চোখে দেখলাম, রাত জেগে থাকার জলছাপ।
পটল কুচির মতো কেটেছো নিজের হৃদয় অজান্তে।”
প্রেম ও বিষাদ: এক ব্যর্থ ভালোবাসার আত্মকথন
শফিক নহোরের প্রেমিক সত্তা বিষাদের ছায়ায় ঢেকে আছে।
‘একটি দীর্ঘশ্বাস’ কবিতায় তিনি বলেন:
“প্রেমিক হতে এসেছিলাম; তাই সব সয়ে গেলাম।
কাপুরুষ নই, জেনে রেখো…
শুধু তোমার মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে,
কৈফিয়ত চাইবার দুঃসাহস আমার নেই।”
এই কবিতায় প্রেমিক একদিকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, আবার অন্যদিকে প্রেমিকার প্রাপ্য অধিকার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। বিষণ্ণ আত্মসমর্পণের গভীরে যে প্রেম আছে, তা শফিক নহোরের কবিতাকে আরও মানবিক ও হৃদয়স্পর্শী করে তোলে।
সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি: দ্রোহের ভাষা
সমাজে নেমে আসা রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কবি বারবার রুখে দাঁড়ান।
‘আধুনিক দাসত্ব’ কবিতায় তিনি লেখেন:
“দাসত্ব ভেঙে দাও হে অদৃশ্য ঈশ্বর
তোমার নাম করে প্রতিদিন দৃশ্যমান হয়
কিছু সুবিধাভোগি ঈশ্বর…
তাদের হাতেই আজ অক্সিজেন।”
অন্যদিকে ‘সূচক’ কবিতায় কর্পোরেট নিপীড়নের নগ্ন বাস্তবতা তুলে ধরেন:
“মানুষের মাংসের দাম কমেনি,
শেয়ারবাজারের সূচক আগের মতই আছে।”
এই পংক্তিগুলো বাংলাদেশের কর্পোরেট পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতি কবির নির্মম এবং দুঃখমাখা প্রতিক্রিয়া।
প্রকৃতি ও জনজীবন: ধ্বংস ও প্রেমের ছায়া
‘সবুজ বৃক্ষের জন্য কাঁদি’ কবিতায় তিনি কুয়ার মৃত্যুর কথা বলেন:
“কুয়া মরে গেল, তাজা নদী মরে গেল
অসুখে ভুগছে সাগর আর সমুদ্র সৈকত।”
এই চিত্র শুধু প্রকৃতির মৃত্যু নয়, বরং মনুষ্য সভ্যতারও একধরনের আত্মঘাতী প্রবণতার ইঙ্গিত।
তেমনি ‘দুধধান’ কবিতায় প্রকৃতি ও নারীর মিলনে ধর্ষণ, রক্ত, অপেক্ষা ও মৃত্যু একাকার হয়ে যায়:
“ধর্ষিত অবুঝ বালিকা!
রক্তনদী স্যাঁতসেঁতে হয় টিউবয়েলের চারপাশ।”
শহুরে যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি: নিঃসঙ্গতা ও আত্মহত্যা
‘বৃক্ষের পাতাঝরা দিনে’ কবিতায় তিনি লেখেন:
“এই শহরে কোনো প্রেমিকা নেই
নেই জড়িয়ে ধরবার মতো কোনো বৃক্ষ”
এমন পংক্তিতে ফুটে ওঠে শহরের নিঃসঙ্গতা ও রোবোটিক জীবন। যেখানে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, আছে কেবল ‘আত্মহত্যার অক্ষর’।
প্রতিবাদ ও বিপ্লব: নারীর জাগরণ ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
‘ফাঁসির মঞ্চের রশি’ কবিতায় তিনি সাহসী উচ্চারণ করেন:
“শাড়ির আঁচল হোক ধর্ষণকারীর
ফাঁসির মঞ্চের রশি, জেগে উঠুক নারী।”
এই এক পংক্তিই যেন তাঁর নারীবাদী অবস্থানের প্রতীক। নারীর শাড়ি তাঁর কাছে লজ্জার নয়, প্রতিশোধ ও বিপ্লবের প্রতীক।
ভোগবাদী কালচার ও মূল্যবোধের ক্ষয়
‘ভোগবাদী কালচার’ কবিতায় তিনি বলেন:
“মানুষ রং বদলায় কারণে-অকারণে
শুধুই নিজের স্বার্থে—
কেউ কেউ ব্যতিক্রম, তারা আলোর মতো ধরা যায় না।”
এই আলোর মানুষদের অনুসন্ধানই তাঁর কবিতার মৌলিক লক্ষ্য।
শফিক নহোর কেবল একজন গল্পকার নন, একজন সংবেদনশীল কবিও। তাঁর কবিতাগুলি মানব জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, সামাজিক অসঙ্গতি এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করে। তাঁর ভাষা সহজবোধ্য হলেও তাতে গভীর দার্শনিকতা বিদ্যমান, যা পাঠককে ভাবিয়ে তোলে। তিনি তাঁর কাব্যে সমাজ, জীবন এবং সম্পর্কের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন, যা তাকে বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ করে তুলেছে। তাঁর কবিতাগুলি যেন সমাজের দর্পণ, যেখানে প্রতিফলিত হয় আমাদের চারপাশের বাস্তবতা, হতাশা, প্রেম এবং প্রতিবাদের এক মিলিত সুর। তিনি যেভাবে প্রেম, প্রতিবাদ ও পরাবাস্তবতাকে মিলিয়ে এক নতুন বাস্তবতা নির্মাণ করেছেন, তা দীর্ঘদিন বাংলা সাহিত্যে আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে। তিনি নিছক কবি নন, এক সংগ্রামী কণ্ঠস্বর—যিনি হৃদয়ভাঙা মানুষের মুখপত্র।