আলাউল হােসেন
আব্দুল্লাহেল বাকির কবিতা প্রাণের প্রবহমানতার প্রতিবেদন। স্বভাবত সঙ্গ ও নৈঃসঙ্গের অদ্বয়বোধ তাঁর কবিধর্ম। ফলত কবিতায় তিনি কাহিনী খুঁজে নিতে চান। ১৯৬৫ সালের ১ ডিসেম্বর পাবনা জেলার বেড়ার উপজেলার নতুনপাড়া গ্রামে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি ঝোঁক। ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮ বছর শিক্ষকতা করে পেশা পরিবর্তন করে বর্তমানে তিনি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে কর্মরত আছেন। ‘প্রাকৃত পাখির গান’ নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। ‘উদাস আব্দুল্লাহ’ তাঁর কাব্যনাম।
আধুনিক বাংলা কবিতা যতটা না বিষয়ের, তার বেশি আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার। ফলে রোমান্টিকদের সঙ্গে আধুনিকদের প্রাকরণিক পার্থক্য স্পষ্ট। যেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দের। এই ধারাবাহিকতা বর্তমানকালের বাংলা কবিতায়ও সমুপস্থিত। এই সময়ের প্রধান কবিদের অনেকেরই উন্মেষকাল মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে। ওই সময়ের কবিতার বিষয়-আশয়ের বিপুল অংশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ক্ষোভ, দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক অনুষঙ্গই বেশি। তবে কেউ কেউ সমকালের স্রোতের ভেতর থেকে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছেন, নিস্পৃহ-নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির জোরে। ফলে এ ধারার কবিরা সমকাল থেকে রসদ গ্রহণ করেও সমকালের প্রভাবে প্রভাবিত হননি, স্বকালকে প্রভাবিত করেছেন। সাধারণত স্বকালের ওপর তাদের প্রভাব এমন সর্ববিস্তারী হয় যে, কালের উত্তাপ তাদের পোড়াতে পারে না, স্পর্শ করে মাত্র। আব্দুল্লাহেল বাকি এই ধারারই একজন।
আব্দুল্লাহেল বাকির কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নৈর্ব্যক্তিকতা। কেননা, তিনি জানেন, আত্মবিস্মৃত না হয়ে সর্বসংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ রাখতে গেলে কবির নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি প্রয়োজন।
অনাদি
অনশ্বর
অনিকেত
একাকি অশ্বারোহীর সেই দৈব বাহন
খোঁজে তার দ্রষ্ঠার দ্বিতীয় দোসর!
উন্মত্ত, অস্তি’র!
তার উন্মাতাল কেশরের ঝাপটায় উঠে আসা ঘুর্ণি হাওয়ায়
উড়ে আসে নেবুলার ছাই,
আর তীব্র ক্ষুরের অবিরাম সংঘর্ষে, সংঘর্ষে জ্বলে ওঠা
স্ফুলিঙ্গে স্ফুলিঙ্গে দৃশ্যমান এই অনন্ত তারার আকাশ!
(অনন্তের অশ্বারোহী)
আধুনিক কালের কবি তার উপস্থিতকালের প্রধান অসুখ শনাক্ত করেন এবং এ থেকে নিরাময়ের স্বপ্ন দেখান জাতিকে। এ কারণে তাদের কাজে নিজের কাল তেমন গুরুত্ব পায় না। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বিষয়-আশয় থেকে তাদের কবিতার রস ও রসদ সংগৃহীত হয়। অর্থাৎ অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের রুচি এবং ভবিষ্যতের স্বপ্নচারণ- এই তিনের মিথস্ক্রিয়ায় সৃজিত হয় কবিতার অন্তরাত্মা ও অবয়ব।
যে সব অরণ্যে, পাহাড়ে অথবা সমুদ্র তীরে তোমরা বেড়াতে গিয়েছো ঢের
আমার যাওয়া হয়নি
আমি যেতে পারিনি
আর হবেও কিনা জানি না!
শুধু জানি ওসব কিছুই আমার স্বশরীরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে না!
আমি অপেক্ষায় থাকি!
কখন ঐসব অরণ্য, পাহাড় আর সমুদ্রের চোখ দেখতে আসবে আমাকে!
(দর্শন)
চিন্তা ও কল্পনার সমন্বয়ে কবিতায় বুদ্ধি ও আবেগের সুষম সম্পর্ক রক্ষা করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আধুনিক কবি অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটান। নারী-পুরুষের প্রেম, প্রকৃতি, নদী, দেশপ্রেম, যুদ্ধ, ধর্ম, দর্শন ও রাজনীতি ছাড়াও মনোবিকার, ক্ষোভ, হতাশা, যৌনতা, বিশ্বায়ন, সর্বপ্রাণে প্রেম, যুদ্ধবিরোধী মনোভাব, সমকালের বিশেষ ঘটনার রেশ ইত্যাদি আধুনিক কবিতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে। তার কবিতায় বিষয় বিচিত্র। কোনো নির্দিষ্ট ছকে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি জীবনের ছবি থেকেই আমি তুলে আনেন কবিতার চিত্রকল্প। জীবনের হাসি-কান্না হাহাকার থেকেই উঠে আসে কবিতার ধ্বনিময়তা।
তবুও কলম ধরে বসে থাকি, টেবিলে
তুমি যেরকম বসে থাকো প্রার্থনা গৃহে …
কবুল হোক বা না হোক, আত্মার আরতি অজর… অপার!
মাথার মুকুট খুলে জুতার বুকের ভেতর রেখে এসে
এখানে দাঁড়ায় সারি সারি কাঙ্গালের দল, কাধে কাধ, আগপাছহীন পায়ের আঙ্গুল।
এ দৃশ্য সাম্যের অধিক তত্ত্বের তেজারতির দ্বার।
জানি এখানে দাঁড়াতে হলে মুকুটের পাশে নামিয়ে রাখতে হবে অদ্বিতীয় কলমের ধার।
কেন যে আমি আজো কলম ধরে বোবা হয়ে বসে থাকি তবু,
প্রার্থনা বুঝি আর হবে না আমার!?
(প্রার্থনা বুঝি আর হবে না আমার)
সমকাল ও সমাজকে অনুভবে ধরাই একজন কবির মৌলিক কাজ। বস্তুসত্য সেখানে অর্থহীন। অনর্থক তার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা। মরীচীকার নাগাল পাওয়া মানবজীবনের স্বপ্নের অসাধ্যও। বাস্তবের সঙ্গে তার সম্পর্ক মনোভূমিকেন্দ্রিক। বস্তুগত সত্যের সঙ্গে সম্পর্ক অসম্ভবের। জাতীয়তাবোধের প্রশ্নে, স্বজাতির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতিচ্ছবি আঁকা দেশপ্রেমিক কবির দায়। সে দায় পালনে তার কাব্যিক সততা তাৎপর্যময়।
বুননের ছলা-কলায় ব্যস্ত যে ব্যকরণ, সত্যিই অকারণ!
কাঙ্খিত কাব্যলেখা, দেবে না দেখা, টক-শোতেই
ঝুলে আছে যাবতীয় জাগরণ!
যত ধ্যান- ধান্দাবাজে, মেধার দখলে মাছের বাজার!
প্রজ্ঞা-বানে ভেসে যাচ্ছে পাজেরোর ঝাঁক,
আজ আমাদের বন্ধু কেবল কাক!
দোয়েল
কোকিল
সবাই অবাক !!
(সংক্রান্তি)
কোনো বিশেষ নারী যেমন তার আরাধ্য, তেমনি নির্বিশেষ নারীও। আবার কেবল নারীপ্রেমেই সীমাবদ্ধ নন কবি, চরাচরের অশরীরী প্রাণের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার স্বপ্ন দেখেন। কবি যেন বস্তুবাদী ধারণা থেকে ভাববাদী চৈতন্যে পরিভ্রমণ করেছেন। কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারেননি। মূলত কবি কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির বিষয়ে কবিতা রচনা করেননি। তার কবিতা হয়ে উঠেছে বহু বিষয়ের বহুরৈখিক প্রকাশ।
রোদ্দুরকে রেখে এসে অরণ্য চূড়ায়
আমি পরিশ্রান্ত মাংসের মূর্তিকে আড়ালে এনে
মাথার উপর ছেড়ে দিলাম বৃষ্টির শাওয়ার।
একটা নদী টেনে নিয়ে গেল স্থাপত্যের শহরের
নর্দমার যত ডিপোজিট ক্লেদ আর জল।
একটা জনস্রোত আজো ক্লান্ত স্বরে বয়ে বেড়ায় তোমাকে;
তুমি নামছো না আর আকাশ থেকে!
না মিশছো কোন কাক্সিক্ষত স্বপ্নের সমুদ্রে।
(তুমি নামছো না আর আকাশ থেকে)
অব্দুল্লাহেল বাকি যেকোনো বিষয়কে কবিতা করে তুলতে জানেন। স্বাভাবিক কবিত্বশক্তি নিয়ে জন্মেছেন তিনি। যেকোনো অনুভবকে সংযমশাসিত কবিতা করে তুলতে পারেন, তার অনুভব এত সৎ ও গভীর যে, তার প্রকাশও স্বচ্ছ-সাবলীল এবং ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে ওঠে। তবে এই স্বাভাবিক কবিত্ব শক্তি স্বভাবকবির নয়, অভিজ্ঞতাঋদ্ধ, বহুলপাঠে আত্মপ্রস্তুতিসম্পন্ন প্রাজ্ঞের। ফলে নিজের অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন, কল্পনা ও মনীষাযোগে যেকোনো বিষয়ে কবিতাসৃষ্টি তার জন্য সহজ।
কোটি কোটি জ্বলন্ত নক্ষত্রের ওই অগ্নিবলয়ের নাম ছায়াপথ!
একটা প্রশ্ন ঠিকই কুঁচকে ফেলে কপালসহ ভুরু,
আমার মনে খটকা লাগে, গুরু।
তুমি বললে, শোন হাঁদারাম, একটা তারা আলোর প্রদীপ বটে,
তয় লক্ষ কোটি তারার মিছিল, দেখ না ভেবে, কেমন করে ছায়া।
আধাঁর ভরা জগৎ জুড়ে এ সংসারে আলোর মানুষ কত?
সেই সমাজের স্বপ্নখানি দেখ, পাবি খুঁজে সেই অমৃতের মায়া।
বুঝলি এবার, বাংলা ভাষা ভায়া???
(ভাষা সন্দর্শন)
আব্দুল্লাহেল বাকি কালসচেতন বলেই সমকালকে শব্দে-বাক্যে-পংক্তিতে ধারণ করেন সচেতনভাবেই। তাতে কবিতা সমকালের ফসল হয়েও চিরকালীন হয়ে ওঠে। সমকালীন রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা ভাব, কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব কবির মনোবিশ্বকে আলোড়িত করে, ব্যথিত করে; করে ক্ষত-বিক্ষতও। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ধর্মীয় উন্মাদনার সংক্রমণে কবি ব্যথিত। ছন্দ মানা ও ছন্দভাঙার প্রতি তার সমান আগ্রহ, চিত্রকল্পে রয়েছে নিজস্ব রুচির পরিচয়।