আলাউল হোসেন
আনিসুল হক বরুণ মঞ্চ এবং টেলিভিশন নাটকের অন্যতম প্রধান অভিনেতা। ইতোমধ্যে তিনি নাট্যঅঙ্গনে সফল ও নান্দনিক পদচারণার স্বাক্ষর রেখেছেন। মঞ্চ নাটক বা থিয়েটারে অভিনয় ছাড়াও নাট্যনির্মানে অর্থাৎ প্লেডিজাইন ও কোরিওগ্রাফি এবং নির্দেশনায়ও তার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তার প্লেডিজাইন ও কোরিওগ্রাফি বা নির্দেশিত নাটকগুলো ব্যাতিক্রমতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। টিভি নাটকে অভিনয় করে অল্পদিনেই দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। সেই সাথে তিনি আধুনিক কবিও। তিনি তার কবিতায় আকণ্ঠ আধুনিকতায় নিমজ্জিত। কবিতার দশকের পাতায় যদি তাকে বসানো হয় কিংবা ভাগ করা হয় তা হলে তিনি নব্বই দশকের কবি। নব্বইয়ের কালপর্বে পাবনায় যারা একনিষ্ঠভাবে কবিতাচর্চায় নিজেদের পুরোপুরি সমর্পণ করেছেন, ডুবেছেন ছন্দে-অলংকারে তাদের মধ্যে কবি আনিসুল হক বরুণ অন্যতম একজন। কবিতায় তিনি সহজিয়া অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে, বরং কবিতার অন্তর্লীন বিষয়াদিকে এক একটা করে ধরে-ধরে আর সচেতনভাবে এক দারুণ সূক্ষ্ম ছন্দোময় রসাত্মক ও ভাবমধুর দৃষ্টির মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন।
‘ইন্দ্রের মন্দিরে ঘণ্টা বাজার পর যতদূর তাকাই/ ঘন, আরো ঘন কুয়াশা/ তার ওপারেও সভ্যতা হবে একদিন/ কেবল শুশ্রƒষার কাছে নতি শিকার/ শিকারী পুরুষের’- এরকম অসংখ্য কবিতা লিখে একসময় ঝড় তুলতেন সাহিত্যাঙ্গনে। শব্দকে ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে দেয়ার চমৎকারিত্ব, পঙক্তিগুলোকে এক ধরণের রহস্যময়তা ছিন্ন করে আরেক রহস্যে পৌঁছে দেবার এক অদ্ভুত কুশলতা এবং ছন্দপতনকে প্রশ্রয় না দিয়ে ছন্দ প্রয়োগের অনায়াস দক্ষতা তার কবিতার শরীরকে করে কারুকার্যময়। তাইতো আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠকরা হয়তো বরুণকে কবি হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা, বর্তমানে তাকে কবিতা থেকে অনেকটাই দূরে সরিয়ে রেখেছে।
আনিসুল হক বরুণ ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাবনা জেলার গোপালপুর মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৃত কাজী ময়নুল হক ও মাতার নাম আফরোজা বেগম। পিতা কাজী ময়নুল হক স্কয়ার ফার্মাসিউটিকাল লিমিটেড এর শুরুর সময় থেকে ল্যাবরেটরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। মাতা গৃহিণী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বরুণ তৃতীয়। তিনি পাবনার গোপাল চন্দ্র ইন্সটিটিউট থেকে ১৯৮৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক শেষ করেন। ১৯৯৪-৯৫ সেশনে ভারতে ঘওঋঅ – তে ফিল্ম বিষয়ে লেখাপড়া করেন এবং পরবর্তীতে ঢাকার শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
খুবই বন্ধুবাৎসল, আড্ডাপ্রিয় বরুণের ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন তার সহপাঠিদের নিয়ে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের সমস্ত গল্পকে নাটক বানিয়ে মঞ্চায়ন করতেন তার পাবনা শহরের বাড়ির উঠানে।
বরুণ ১৯৮৭ সাল থেকে থিয়েটার করছেন; যান্ত্রিক নাট্যগোষ্ঠীর ‘ঈশ্বর ফিরে যাও’ দিয়ে তার হাতেখড়ি। তারপর কারক নাট্য সম্প্রদায়ের, অনুশীলন আশি, নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায় এবং সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার হয়ে বর্তমানে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে নিয়মিত কাজ করছেন। সেই সাথে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অডিওভিজুয়াল আর্কাইভ এবং ডকুমেন্টেশন বিভাগের দায়িত্বে কর্মরত আছেন।
কবি আনিসুল হক বরুণ কবিতায় দেখিয়েছেন বিস্তীর্ণ আলোময় এক পথ। আত্মমগ্ন ধ্যানে এক বিপন্ন সময়ের নতুন স্বপ্ন। কবিতার আবরণে যাপিত জীবনের যতসব আবেগ, অনুভূতিগুলো তুলে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি। যেখানে তিনি অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ করেছেন। তিনি সহজ করে সহজভাবে মনের কথাটি বলতে পারেন-
স্বতঃসিদ্ধ নয়,
স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজাত উন্মোচনের আকাক্সক্ষা
গতিপ্রাপ্ত হলে,
জীবনের অনুষঙ্গগুলো যখন প্রসঙ্গের চরিত্র পায়
ঠিক তখনই
প্রকৃতি সাড়া দেয় মিলনের।
কিছুকাল গভীর উপলব্ধির মধ্যে বসবাস।
তারপর
বানিয়ে তোলা আর প্রকৃত সত্য মুখোমুখি হলে
কেউ কেউ খুঁজে পায় অনন্ত প্রশান্তির সারাৎসার
অথবা বদ হাওয়ায়
চোখের সামনে বদলে যায়
মনের সামনে জ্বলে থাকা স্বয়ম্ভু আত্মার বাতিঘর।
(ভিন্নদশা)
তাঁর বলনের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি অন্যভাবে কবিতার উঠোনে হাঁটতে পারেন। কবির জীবনাচার আর নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়াদি তার কবিতায় প্রকটভাবে ধরা পড়ে। ভেতর থেকে সামগ্রিক প্রকাশের এক সফল প্রচেষ্টা তিনি বরাবরই করেন।
কোন একদিন হয়ত তাদের সঙ্গে
আমাদের দেখা হবে, কিংবা
কোনদিনই দেখা হবে না।
তবে, আমাদের সঙ্গে কিন্তু
আমাদের দেখা হবে, যুগে-যুগে
কালে-কালে, কথা হবে
প্রতিমূহূর্তে, প্রতিপলে
মূলত, আমাদের সঙ্গে আমাদের
দেখা হবেই।
আমরা মহাকালের আত্মা থেকে বার-বার
এই খণ্ডকালের শরীর থেকে শরীরে এসে, আবার
মহাকালে মিলে যাব।
আমরা ছিলাম
আছি
এবং থাকব।
(আমাদের আমরা চিরকালের)
কবিতার আঙিনায় তাঁর বপন করে যাওয়া কবিতায় আছে এক নিজস্ব সত্তার বীজ এবং তা বেড়ে উঠে নিজের মতন করে। তিনি কবিতার ভেতরে পৃথক এক আবহ নিয়ে আসেন। যা কবিতা পাঠকের হৃদয়ে মোচড় দিতে পারে। তিনি কবিতার ভেতর কবিতার পংক্তিমালায় এক প্রথাগত নির্মাণকলার ভিন্নতর এক নান্দনিক সৌকর্যে বিন্যস্ত করেন। যা এক নিজস্ব ঢঙে। তার কবিতায় মাটির ঘ্রাণ থাকে মাটির মতন করে, ভেজাজলের কলরোল থাকে। থাকে পাশাপাশি মানবিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ আর হতাশার নানা বিষয়। সব কিছুই প্রাধান্য পায় তার কবিতায়। কবিতার কাব্যশরীর নির্মাণে ভিন্নতা থাকে এবং অন্যরকম বৈচিত্রের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে সংশয় হতাশা স্বপ্নভঙ্গের এক বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রকাশ করেন পংক্তিতে-পংক্তিতে।
আমার রক্তের মধ্যে অবিরাম ঝরে পড়ছে
অসহিষ্ণু সময়ের দৃষ্টিপাত, জলছবি,
মগজে আটকে যাওয়া সেইসব দৃশ্যপট
যা যতœকরেও ভুলে যেতে পারে না মানুষ,
অসীমতা আর স্বসীমত্তের মধ্যে
যে দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত আমাকে অস্থির করছে স্থিরতার জন্যে
সেই সব উদ্বেগ আর উৎসাহকে ভালোবাসা নাম দিলে
তা নিজের হয়ে দেখা দেয়
ভালোবাসা তার আন্তর্জাতিক মাটি, পানি আর আকাশ
ব্যবহারের সঠিক হিস্যা চায়
যেমন জ্ঞান সীমাবদ্ধতা পছন্দ করে না।
(স্বদেশ আমার)
তাঁর কবিতার আঙ্গিক অসাধারণ রকমের সুন্দর আর প্রাঞ্জল। কবিতার অন্তরঙ্গ-বহিরঙ্গে দ্যোতনা থাকলেও ব্যঞ্জনময়তার কারণেই তিনি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন। ভাঙাগড়া আর ব্যক্তিক টানাপোড়েনকে তিনি তার নিজস্ব চেতনার প্রস্ফুটন ঘটাতে দারুণভাবে সচেষ্ট আছেন। তার কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচনেও তরতাজা আর সমকালীন। কবিতাগুলোর প্রকরণ অভিনব, আর ভাষা সহজ। তার নিমগ্ন ভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রেও কোনো প্রকার তাড়াহুড়ার বিষয় খুঁজে পাওয়া যায় না।
বৃষ্টির বিপরীত বাতাসে রংধনু দেখে
হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে
সদ্য বর্ণমালা পড়তে শিখেছে যে শিশুটি।
নশ্বর বিশ্বাসে বেড়ে উঠি বিভ্রান্তির শুরঙ্গগুহায়
আমরা নত হতে শিখিনি সত্যের অহংকারে
এভাবে পাল্টে যায় আমাদের পূর্ব আর উত্তর পুরুষেরা
দীর্ঘ পরিকল্পনার পর সুর্যের মুখোমুখি হলে
পরিরা উড়ে যায়,
পরে থাকে কল্পনার করোটি, কঙ্কাল।
(আমরা)
কবিতা একটি নির্মাণকলা, অন্যান্য শিল্পের মতো একেও নির্মাণ করতে হয়; কিন্তু সবার নির্মাণশৈলী নান্দনিক হয়ে ওঠে না। যার ভেতরে সত্যিকার কাব্যহৃদয় আছে, যিনি কবিতাকে আপনমনের সবচাইতে মহার্ঘ্য সত্তা হিসেবে ধারণ করেন, প্রকৃত পাঠক যার কবিতায় ভাষাশিল্পের অকপট আনন্দের সন্ধান পান; তিনিই যথার্থ কবি। আনিসুল হক বরুণের কবিতা কেবল ছন্দ-অলংকারের স্থুলমূর্তি নয়; তার কবিতা ছন্দসৌন্দর্যহীন প্রেক্ষাগৃহও নয়; তার কবিতা সহজাত শিল্পসৌকর্যে উজ্জ্বল এক একটি নন্দনপ্রতীমা। এই প্রতীমা নির্মাণে যিনি যত বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তিনি তত বড় কবি। আনিসুল হক বরুণের পংক্তিপাঠের মুগ্ধতা আমাদের আবিষ্ট করে রাখে।
কর্ষণে কর্ষণে ক্ষয়ে পরে ক্ষাদ
তারপর অবশিষ্ট জমিতে স্বপ্নিল বাস্তবতায়
বাস্তব মানুষের বসবাস।
এই প্রাসাদ, প্রাসাদের অভ্যন্তরের কৃতদাস
এই বাতাস, বাতাসের ফাঁকে ফাঁকে
জেগে থাকা দীর্ঘশ্বাস আর সময়ের বাঁধ এই শব।
এই সব কিছু উপান্তে ক্ষণিক জীবনের
প্রত্যাশায় জেগে ওঠে সাধ।
তারপর
তারপর ওখানে কোন সময় থাকল না
কোন সংখ্যা থাকল না।
জ্যামিতিক জীবনের যোজ্যতার জ্যা
স্পর্শ করল না কোন সমষ্টিক বৃত্তের প্রান্তর
না কেন্দ্র থাকল বৃত্তের, না পরিধির।
(স্বত্তার সেতারে)
সর্বোপরি আনিসুল হক বরুণ একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি এবং অভিনেতা। তার কবিতার প্রকরণ-ধরণ, বিষয় নির্বাচন সব কিছুতেই রয়েছে এক স্বতন্ত্র ধারা। আর কবিতার সাথে যুক্ত আছে বাস্তবতার উপকরণ। চলচ্চিত্র নির্মাণেও তার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। থিয়েটার নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন; তিনি মনে করেন জেলা শহরগুলোতে থিয়েটার করা সম্ভব হলেই বাংলাদেশের থিয়েটার সমৃদ্ধ হবে।