গানের কবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

আলাউল হোসেন

‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’- গানটি কালজয়ী হয়ে ওঠে সংগীতশিল্পী মান্না দের কণ্ঠে। গানটি লিখেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও সংগীতশিল্পী গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। গৌরপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ। শৈশবে কলকাতা চলে গিয়ে তিনি ফিরে এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। থিতু হয়েছিলেন পাবনা শহরের মজুমদার পাড়ায়। এ সময় সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হন। কিন্তু মনের গহীনে যিনি শিল্পীসত্তা বহন করে চলেছেন তিনি তো সুযোগ পেলে সেদিকেই মন দেবেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল পাবনার আরেক কীর্তিমান সাহিত্যিক, গীতিকবি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের। কিন্তু গানের ফুল ভালো করে ফোটার আগেই ১৯৫১ সালে তিনি পুনরায় কলকাতা চলে যান। ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পরে আবার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করা গৌরীপ্রসন্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দেননি। পিতার ইচ্ছাপূরণে বিলেত যাননি ব্যারিস্টারি পড়তে। তিনি সংগীতে মন সপেছিলেন। গান লিখেই তিনি ক্ষান্ত হতেন না। গানে সুরারোপ, মহড়া, এমনকি রেকর্ডিং পর্যন্ত তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। যদিও তার মধ্যে কখনও পেশাদারী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘চল্লিশ বছর ধরে তো শুধু একই চিন্তা! কথা সাজানো আর মিল জোড়ানো। কোথায় আমার ঘর, আমার সংসার?’

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ার সময়ই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। যদিও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তার লেখা গান প্রথম রেকর্ড হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা যায় প্রথম গান- ‘আকাশ মাটি ঐ ঘুমালো, ঘুমায় মেঘ তারা।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় তার সেই বিখ্যাত গান ‘শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠে সুরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি; বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ…।’

তার লেখা এই গান একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে লক্ষ প্রাণে শিহরণ বইয়ে দিত। অনুপ্রেরণা জোগাত মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিপাগল বাঙালির হৃদয়ে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার শুধু যে দ্রোহের গান লিখেছেন তা তো নয়। তিনি প্রেম, বিরহ, মানবতা, বিজয়ের গানও লিখেছেন। তার বহু গান এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। এখনও বেজে ওঠে খ্যাতিমান শিল্পীদের কণ্ঠে। এরমধ্যে শিল্পী মান্না দের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। তার লেখা গান কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পীর কণ্ঠে অমরত্ব পেয়েছে। বিবিসি’র করা জরিপে সেরা বাংলা গানের তালিকায় প্রথম ২০টি গানের মধ্যে তাঁর লেখা গান ছিল ২টি- ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’; ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’।

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা রোমান্টিক গান সে সময় বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। বাংলা গানের সব চেয়ে সারা ফেলে দেয়া ডুয়েট গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’ অথবা ভিন্নধর্মী ফর্মের গান ‘এই রাত তোমার আমার’; ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’। উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলির রচনা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের। অগ্নিপরীক্ষা ছবিতে ‘কে তুমি আমারে ডাকো আড়ালে লুকায়ে থাকো’, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’, সবার উপরে ছবিতে ‘ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা’, ‘জানিনা ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া’, সাগরিকা ছবির ‘আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে’, হারানো সুরের ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’, ‘তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার’, পথে হলো দেরী ছবির ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে’, ইন্দ্রানী ছবির ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’, ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশতো’, সপ্তপদী ছবির ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’সহ আরো অনেক গান রচনা করেছেন তিনি।

উত্তম কুমারের অন্য নায়িকাদের ছবিতেও তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গান ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে’, ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’, ‘গানে ভূবন ভরিয়ে দেবে’, ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন’, ‘দোলে দোদ্যুল দোলে’, ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর’, ‘পৃথিবী বদলে গেছে’, ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী’, ‘আমার হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’, ‘আমি যে জলসাঘরে বেলোয়রী ঝাড়’, ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’, ‘সেই বাসর নেই বাঁশরী নেই’, ‘মাধবী মধুপে হলো মিতালী’, সহ আরো কত গান।

তার গানের বাণী কখনো একঘেঁয়ে নয়। ভাব, ভাষা, শব্দ, ছন্দ ও রচনাশৈলী নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। একই ফর্মে বেশিদিন গান লেখেননি। এ ব্যাপারে ছিলেন সতর্ক, সচেতন। সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘আমি চেষ্টা করি এক এক সুরকার ও গায়কের জন্য এক এক রকম গান লিখতে। অনেক সময় সুরের স্বাধীনতা স্বীকার করে শব্দ বসাই।”

গৌরীপ্রসন্ন ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সবুজের মেঠো ছায়াপথ নয়, দেখেছেন বিধ্বস্ত দেশ, পিতৃস্মৃতি হাতড়াতে ঘুরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ছবি পরদিন ঢাকার কাগজে ছাপা হয়েছিল। সে সময় স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই মনে পড়ল জন্মস্থানের কথা। ছুটে এলেন কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা দেখতে। শহীদ সাধন সংগীত মহাবিদ্যালয়ে দুই বাংলার প্রখ্যাত গীতিকবিকে দেওয়া হলো সংবর্ধনা। সেদিন মঞ্চে ছিলেন সহপাঠী ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং অধ্যক্ষ কবি আব্দুল গনি। শচীন দেব বর্মনের হাতেই বাচ্চু মজুমদার থেকে গীতিকার গেীরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্ম হয়।

ছায়াছবির বাইরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মুঙ্গেশকর, কিশোরকুমারসহ প্রায় সকল জনপ্রিয় শিল্পীর গলায় ধ্বনিত হয়েছে তাঁর লেখা গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’, ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’; সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’ কিংবা ‘জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে’; মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বনে নয় মনে মোর পাখি আজ গান গায়’; সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’; শচীন দেব বর্মনের ‘বাঁশী শুনে আর কাজ নেই’; লতা মুঙ্গেশকরের ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’; ‘ও পলাশ ও শিমুল’, কিশোর কুমারের ‘আকাশ কেন ডাকে’; মান্না দের কন্ঠে ‘তুমি আর ডেকো না’, ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’, ‘যদি কাগজে লেখ নাম’; ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’, ‘আমি নিরালায় বসে বেঁধেছি আমার স্মরণ বীণ/একি বেদনার মতো বেঁধেছি আবার হারানো দিন’ এই গানগুলো এখনও হৃদয়ে ঝড় তোলে বাংলা গানের শ্রোতাদের। এমন অসংখ্য হৃদয়গ্রাহী গানের বাণী তিনি লিখেছিলেন সে সময়।

এ রকমই ছিল তখনকার সৃষ্টিশীল মানুষের মন ও মনন। তখন তো আর বিশ্বায়নের বেহায়া বাঘ ছিল না। অনেক কষ্ট-শ্লেষ সয়ে অবশেষে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মহান এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চলে যেতে হবে আগেই বুঝতে পেরে লিখেছিলেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখ না’। গানটি তার মৃত্যুর পর শিল্পী আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়। সেই রেকর্ড আজও বাজে বাংলার কোনো না কোনো ঘরে।

‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায়’- শ্যামল মিত্রের গাওয়া এই গানে গৌরীপ্রসন্নের আকুতি বেঁচে আছে, তবে তিনি আর নেই। তবে তার গান বাংলার সঙ্গীত পিপাসুদের মনে বেঁচে থাকবে চিরকাল।
আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে
পান্থপাখির কূজন কাকলি ঘিরে
আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শুনো
আমি যদি আর না আসি হেথা ফিরে।

শিল্পীর সেই চিরন্তন চাওয়া, বেঁচে থাকে তার সৃষ্টিতে, মানুষের মনে দোলা দিয়ে যাক চিরদিন। গীতিকবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখনীতেও সেই চাওয়ারই প্রতিফলন ঘটেছে।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না