আলাউল হোসেন
বাংলাদেশের এখনও ৩০ শতাংশ মানুষ হোমিওপ্যাথির উপর আস্থা রাখেন; অনেক মানুষ এখনও বিশ্বাস করে হোমিওপ্যাথি জটিল-কঠিন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম; কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই হোমিওপ্যাথি ওষুধ কাজ করে। এই কথায় আমার ঘোর আপত্তি। আমরা সকলেই জানি ও মানি- প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। হোমিও ওষুধ যদি ক্রিয়া করে, তবে প্রতিক্রিয়া কেন করবে না?
অনেকেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সরাসরি বলেন- হোমিওপ্যাথি কোন বিজ্ঞান নয়, এটি পুরোপুরিই অপচিকিৎসা। ঢালাওভাবে উল্লিখিত ওই কথার সাথেও আমি একমত নই। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে বিজ্ঞান না বলার কোন কারণ নেই। বস্তুত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে নষ্ট করেছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি। পরিসংখ্যান আমার জানা নাই। তবে নিজের এলাকার হিসাবমতে, সারাদেশে অন্তত অর্ধ লক্ষাধিক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক রয়েছেন। যাদের মধ্যে স্নাতক ডিগ্রিধারী কয়জন থাকতে পারেন? বড়জোর এক-দেড় হাজার। বাকি সব কথিত ডিপ্লোমাধারী। কথিত বলছি এই জন্য যে, ডিএইসএমএস নামক এই ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হতে কোনমতে এসএসসি পাশ হলেই চলে। বিজ্ঞান বিভাগের কোন বাধ্যবাধকতা এখানে নেই। একটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা কোর্স পড়তে যাচ্ছে বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিরা…! ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলবো না। তবে দুএকটি ব্যতিক্রম কখনও উদাহরণ হতে পারে না।
হোমিওপ্যাথির জনক ডা. হ্যানিমেন এর হোমিও চিকিৎসার দর্শন নিয়ে দুএকটি আর্টিকেল পড়ার সুযোগ হয়েছে। তাতে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে- হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হতে হলে অবশ্যই তাকে সাধক হতে হবে, হতে হবে দার্শনিক। একজন রোগীর চেহারা দেখে তার সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা নেবার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। কোন রোগী কিন্তু তার নিজের চারিত্রিক সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কথা চিকিৎসককে খুলে বলেন না। বড়জোর ৫০% একজন চিকিৎসক জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে নিতে পারেন। বাকি ৫০% চিকিৎসকের দায়িত্বে বুঝতে হবে। এখানে কমতি হলে কখনও হোমিও চিকিৎসায় একজন রোগীকে আরোগ্য করানো সম্ভব নয়।
মোটের উপর কথা- রোগীর মায়াজম বুঝতে হবে তার চলন-বলন ও কথা বলার ধরণ দেখেই। আর যদি একজন চিকিৎসক কেস টেকিং এর মাধ্যমে তার মায়াজম বের করতে চান, তবে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা সময় রোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তবু্ও রোগীর কাছ থেকে শতভাগ সঠিক তথ্য বের করা সম্ভব হবে না। আর শতভাগ মায়াজম বের করে চিকিৎসা না দিলে কখনও হোমিও ওষুধ কাজ করবে না। বরং ওষুধ রোগীর শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।
আমাদের এলাকায় সাগরকান্দি নামক স্থানে ডা. শৈলান বাবু নামের এক হোমিও চিকিৎসক সম্পর্কে আমার জানাশোনা আছে। শুধু আমার নয়, পাবনা ছাড়াও দুই চার জেলার মানুষের কাছে তার বহুল পরিচিতি ছিলো। তিনি একজন রোগীকে সামনে দাঁড়ানো দেখলেই ওষুধ সিলেকশন করে ফেলতেন এবং একটি মিডিসিন দিয়ে বিদায় করতেন। ওই রোগীকে সাধারণত আর দ্বিতীয়বার ওষুধ আনতে যেতে হতো না। পাবনার ডা. তারাপদ নামেও আরেকজন তার জীবদ্দশায় এভাবেই রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন। বেড়ার কুদ্দুস ডাক্তারেরও প্রায় একই রকম হাতযশ ছিলো। যাদের নাম বললাম- তারা প্রত্যেকেই সাধক ছিলেন, দার্শনিক ছিলেন। বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সারাদেশেই একসময় ওনাদের মতন কিছু চিকিৎসক পাওয়া যেত, যারা হোমিওপ্যাথির মূল দর্শন ধারণ করতেন, লালন করতেন। এখন কয়জন তা করছেন? গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ হোমিও চিকিৎসক মাইনাস পাস। টেনেটুনে যারা ডিএইচএমএস করেছেন তাদেরও বেশিরভাগ নকল করে পাশ করেন। বস্তুত ডিএইচএমএস কোর্সে কোন ক্লাস হয় না। ক্লাস করে নিয়মিত লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে কেউ ভর্তিও হয় না। ফলে তারা বছরের পর বছর ধরে রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করছেন বটে, কিন্তু রোগ সারাতে পারছেন না। কিছু রোগ একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়, সেটার কৃতিত্ব নেন কথিত ডাক্তার। এই কথিত চিকিৎসকদের মাথাব্যথা হলে নিজেরাই চেম্বারে বসে নাপা খান, প্যারাসিটামল খান। তার মানে নিজের বিদ্যার উপর নিজেরই আস্থা নেই।
কিছু অসহায় মানুষ বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি নিয়ে হোমিও চিকিৎসকদের স্মরণাপন্ন হয়। ফলে এই সময়ের অধিকাংশ হোমিও চিকিৎসক মানুষের সাইকোলজি নিয়ে খেলা করে। যখন রোগী বুঝতে পারে তখন আর কোন উপায় থাকে না।
