আলাউল হোসেন
আমার তখন ষষ্ঠ শ্রেণি। আমি তখন কাশিনাথপুর আব্দুল লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে কেবল ভর্তি হয়েছি। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারির কথা বলছি। একদিন ক্লাস সময়ের অনেক আগেই স্কুলে পৌঁছে গেছি। দেখি স্কুলের গেট বন্ধ। আমি ছাড়া আর কেউ স্কুলে আসেনি। গোটেংড়ার পাশ দিয়ে স্কুলের পেছনে চলে যাই। ভাঙ্গা প্রাচীর বেয়ে স্কুলের ছাদে উঠে পড়ি। সকালের দিকে এক পশলা বৃষ্টিও হয়েছে। ছাদে ছিলছিলে জল জমে আছে। ছাদে জমে থাকা জলে ছুটে বেড়ানোর লোভে পায়ের চপ্পল খুলে পায়ে পায়ে জল নিয়ে খেলতে শুরু করি। তবে বেশিক্ষণ নয়, হঠাৎ আমার চোখে পড়ে একটা দোয়েল ছানা। বাচ্চা একেবারে। ভালো করে চোখ ফুটেনি। শরীরে রোম গজায়নি। ডানায় পালক নেই। আহারে… বাচ্চটির জন্য আমার কষ্ট হয়। কোথা থেকে ছিটকে পড়েছে জানবার কৌতুহল হয়। আর আমার চোখ পড়ে স্কুল বিল্ডিং এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পাকুড়গাছটির একটি ডালে যেটি স্কুলে ছাদের ওপরই ঝুলে আছে। ওই ডালে একটা বাসা খুঁজে পাই আমি। নিশ্চয় তাহলে ছানাটি ওই বাসা থেকে ছিটকে পড়েছে। আমার সাধ হয় বাচ্চাটিকে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে।
কিন্তু সাধ হলে কী হবে? আমার যে গাছে চড়ার মুরোদ নেই। দূরস্ত। গাছে চড়তে আমার ভয় করে। এমন ভাবনায় দোয়েল ছানাটিকে ধরবার চেষ্টা শুরু করি।
যত সহজ ভাবি, ব্যাপারটা তত সহজ নয়, তা বুঝতে পারি ক্ষণিকের মধ্যেই। দোয়েল ছানাটি কিছুতেই আমার নাগালে আসতে চায় না। খালি এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়। আমিও যেন খেলা পেয়ে যাই। ওর পিছু পিছু ছুটে বেড়াতে থাকি। কিন্তু কতক্ষণ? আমার হাসফাঁস ধরে যায়। দোয়েলছানাটিরও। তাই সে আশ্রয় নেয় স্কুল ছাদের উত্তরপশ্চিম কোনের কারনিসে।
এবার বাছা যাবি কতদূর? আমার এমন মনে হয়। আর আমি হাসফাঁস চেপে রেখে এগিয়ে যাই দোয়েল ছানাটির দিকেই। আমার পাতলা দুই হাতের দশটা আঙ্গুল আলতো করি। কোমল করি, যাতে আমার হাতে এসে ছানাটি কোনও কষ্ট না পায়। তারপর আমার আঙ্গুল সাড়াশির মত এগিয়ে নিয়ে যাই।
কিন্তু না, আমার ভুল ভাঙে। দেখি আমার দশটা আঙ্গুলের নাগাল থেকে কোথা থেকে হঠাৎ উড়ে আসা একটা বাজ ছোঁ মেরে দোয়েলছানাটিকে নিয়ে পালায়।
এরপর বাজটি যখন আমার চোখের সীমা ছাড়িয়ে কোথায় মিলিয়ে যায়, তখন আমার দৃষ্টি কেঁপে উঠে। তখন আমাকে ভাবতে হয়, দোয়েলছানাটির পরিণতির কথা- যার শরীরে রোম গজায়নি, ডানায় পালক তো দুরের কথা, যার শরীর তুলতুলে নরম। সেই তুলতুলে নরম শরীরটা আঁকড়ে ধরে আছে ভয়ানক শক্ত তীক্ষ্ন ধারালো নখ! ডানায় পালক গজায়নি, তবুও সে আকাশ বিহার করছে! আর চিঁচিঁ করছে- আনন্দ নাকি ভয়ে ভয়ে তা সেদিন বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি ছাদে দাঁড়িয়ে অসহায়। আমার কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয়, অস্বস্তি হয়। অশ্রুপাত করতে পারলে ভালো হত; এসব থেকে মুক্তি পেতাম। কিন্তু আমি অশ্রুপাত করতে পারি না। কারণ- আমার তখন ষষ্ঠ শ্রেণি, আমি তখন সবেমাত্র হাই স্কুলের শিক্ষার্থী।
পুনশ্চ : স্মৃতিচারণমূলক উল্লিখিত লেখাটি নিছক কোন গল্প নয়। সামান্য একটি বাস্তবিক ঘটনা অবতাড়নার মাধ্যমে সমাজের চলমান কিছু ঘটনার ইঙ্গিত দিয়েছি মাত্র।