আলাউল হােসেন
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর এক বাস্তবতায় অবস্থান করছে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে দিয়েছে—শিক্ষা, বিনোদন, চিকিৎসা, এমনকি পারিবারিক সম্পর্কেও। এই পরিবর্তনের ঢেউ সবচেয়ে দ্রুত ও গভীরভাবে যাদের উপর প্রভাব ফেলছে, তারা হলো আমাদের আগামী প্রজন্ম—শিশুরা। আজকাল শিশুরা জন্ম থেকেই প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসছে। মা-বাবার মোবাইল ফোন, ইউটিউব ভিডিও, ট্যাবলেট, গেমিং কনসোল—এসব যেন শিশুর বেড়ে ওঠার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
শিশুদের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়, তেমনি অসচেতন ও অতিরিক্ত ব্যবহারে সেটি হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ। তাই এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো—প্রযুক্তির ব্যবহারে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে, এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো কী, এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের করণীয় কী হতে পারে।
প্রযুক্তির সুফল: সম্ভাবনার এক নতুন জগৎ
প্রযুক্তির সুবাদে শিশুরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য ও জ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে অনলাইন শিক্ষার প্রসার আরও বেড়েছে। নিচে কিছু ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হলো:
১. শেখার সহজতা ও উপলব্ধি
শিশুদের শেখার প্রক্রিয়াকে আকর্ষণীয় করতে প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। রঙিন ছবি, শব্দ, গান, অ্যানিমেশন এবং ইন্টার্যাকটিভ গেমের মাধ্যমে শিশুদের মনে জ্ঞান সহজে প্রবেশ করে। বর্তমানে এমন বহু অ্যাপ রয়েছে যেগুলো অক্ষর চেনা, শব্দ গঠন, গণিত শেখা, এমনকি বিজ্ঞানের ধারণা বোঝাতেও কার্যকর।
২. সৃজনশীলতা ও মেধা বিকাশ
ডিজিটাল ড্রয়িং অ্যাপ, মিউজিক কম্পোজার, ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার ইত্যাদি শিশুদের সৃজনশীলতার বিকাশে ভূমিকা রাখে। তারা সহজেই গান রেকর্ড করতে, ছবি আঁকতে, ভিডিও বানাতে পারছে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক।
৩. বিশ্বজোড়া সংযোগ ও কৌতূহল সৃষ্টি
প্রযুক্তির মাধ্যমে শিশুরা অন্যান্য দেশ, সংস্কৃতি ও ভাষা সম্পর্কে জানতে পারে। এতে তাদের মনে কৌতূহল বাড়ে এবং তারা বৈচিত্র্যময় পৃথিবীকে বোঝার সুযোগ পায়। এটি তাদের মানসিক বিকাশকে সমৃদ্ধ করে।
প্রযুক্তির কুফল: অন্ধকারের এক সম্ভাবনা
যদিও প্রযুক্তির অনেক সুফল রয়েছে, কিন্তু যখন এটি মাত্রাতিরিক্ত বা অনুপযুক্তভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, আচরণ, এমনকি সামাজিক দক্ষতাও ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিচে এর কিছু কুফল বিশ্লেষণ করা হলো:
১. মনোযোগের ঘাটতি ও অতিরিক্ত চঞ্চলতা
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে ২ ঘণ্টার বেশি সময় স্ক্রিনে কাটায়, তাদের মধ্যে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। দ্রুত দৃশ্য পরিবর্তন এবং উদ্দীপক কনটেন্ট শিশুদের স্বাভাবিক ধৈর্য ও গভীর মনোনিবেশের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
২. ঘুমের ব্যাঘাত ও শারীরিক ক্লান্তি
বেশি সময় স্ক্রিনে কাটানো শিশুর ঘুমের সময় কমে যায়। স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো মস্তিষ্কে মেলাটোনিন হরমোন উৎপাদন ব্যাহত করে, যা ঘুমকে প্রভাবিত করে। ফলে তারা ঘুমাতে দেরি করে, ঘুমের গুণগত মান কমে যায় এবং দিনে ক্লান্ত বোধ করে।
৩. আবেগগত অস্থিরতা ও বিরক্তিভাব
বহু শিশু দেখা গেছে, স্ক্রিন থেকে দূরে নেওয়ার চেষ্টা করলে তারা রাগান্বিত হয় বা কান্না শুরু করে। এটি শিশুর আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার দুর্বলতা নির্দেশ করে। তারা বাস্তব জীবনের হতাশা বা বিরক্তি সহ্য করতে না পেরে অল্পতেই ভেঙে পড়ে।
৪. সামাজিক সম্পর্কের দুর্বলতা
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের বাস্তব পারস্পরিক সম্পর্ক গঠনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তারা বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলার চেয়ে ভার্চুয়াল জগতে সময় কাটাতে বেশি আগ্রহী হয়। ফলে সহানুভূতি, সহযোগিতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ইত্যাদি সামাজিক দক্ষতা গড়ে ওঠে না।
৫. প্রযুক্তি নির্ভরতা ও আসক্তি
অনেক সময় শিশুদের মধ্যে স্ক্রিন-আসক্তি (screen addiction) তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে প্রযুক্তি নির্ভর জীবনধারা, একাকীত্ব, এবং মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ায়। তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায় এবং বাস্তব জীবনের চাহিদা বা দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ দেখা যায়।
সমাধান ও করণীয়: প্রযুক্তির সঙ্গে সহাবস্থান
প্রযুক্তিকে পুরোপুরি বর্জন করা কোনো সমাধান নয়। বরং আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা, পরিমিতি এবং গাইডলাইনের প্রয়োগ। নিচে কিছু বাস্তবসম্মত করণীয় তুলে ধরা হলো:
১. বয়সভিত্তিক স্ক্রিন টাইম নির্ধারণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস (AAP)-এর মতে:
- ২ বছরের নিচে শিশুদের স্ক্রিন একেবারে পরিহার করা উচিত।
- ২–৫ বছর বয়সীদের জন্য প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা মানসম্পন্ন কনটেন্ট দেখা যেতে পারে।
- বড়দের জন্য অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে পরিমিত সময় নির্ধারণ করতে হবে।
২. কনটেন্ট বাছাই ও যৌথ অংশগ্রহণ
শিশু কী দেখছে, তা জানা জরুরি। সহায়ক শিক্ষামূলক কনটেন্ট নির্বাচন এবং শিশুদের সঙ্গে বসে তা দেখা হলে শিশুর শেখার মান উন্নত হয় এবং তারা নিজেকে নিরাপদ বোধ করে।
৩. বিকল্প বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি
শিশুরা যেন প্রযুক্তির বাইরে খেলাধুলা, বই পড়া, ছবি আঁকা, প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো ইত্যাদিতে আগ্রহী হয়, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এতে তাদের মনোযোগ, ধৈর্য ও সৃজনশীলতা বাড়বে।
৪. অভিভাবকের ভূমিকা
মা-বাবাকে নিজেদের স্ক্রিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশুরা যা দেখে, তাই শেখে। তাই বাবা-মাকে হতে হবে ইতিবাচক উদাহরণ।
একই সঙ্গে তাদের উচিত শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো, কথা বলা, আবেগ বুঝে সহানুভূতিশীল আচরণ করা।
ভারসাম্যই সেরা নীতি
প্রযুক্তি আজকের শিশুদের জীবন থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এর ব্যবহারে ভারসাম্য রক্ষা করা ও সচেতনতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
প্রযুক্তি যেন শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়, ক্ষতিকর না—এই দায়িত্ব অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের সকলের। আমরা যদি যথাযথ গাইডলাইন মেনে শিশুর প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তবে প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে তাদের ভবিষ্যতের উজ্জ্বল পথপ্রদর্শক।

