রাষ্ট্রই যদি শিক্ষাকে ধ্বংস করে, তবে কেন শিক্ষক অপরাধী হবেন?

আলাউল হোসেন

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড- এ কথা যুগ যুগ ধরে বলা হয়ে আসছে। কিন্তু সেই মেরুদণ্ড যখন রাষ্ট্র নিজেই ভেঙে ফেলে, তখন শিক্ষককে কেবল দায়ী করাটা কি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়?

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মৌসুম এলেই নকল, প্রশ্ন ফাঁস, শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব বহিষ্কারের খবর শিরোনামে উঠে আসে। সমাজ গর্জে ওঠে- “শিক্ষকরা তো আর শিক্ষক নেই, ওরা এখন সুবিধাভোগী সিন্ডিকেটের অংশ!” কিন্তু কেউ কি কখনো রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তোলে? কেউ কি প্রশ্ন করে- শিক্ষক কেন এই দুর্নীতির পথে নামতে বাধ্য হন?

গভীরে গেলে দেখা যায়, শিক্ষকদের এই তথাকথিত ‘অনৈতিকতা’র জন্মদাতা রাষ্ট্র নিজেই। বিশেষ করে মফস্বলের বেসরকারি শিক্ষকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় একটি নির্মম শর্ত- বোর্ড পরীক্ষায় ৭০% শিক্ষার্থী পাশ না করলে বন্ধ হবে এমপিও। রাষ্ট্রের এমন নিষ্ঠুর, অমানবিক শর্তে বন্দি হয়ে শিক্ষক তখন নীতি নয়, বাঁচার লড়াইয়ে নামেন। ফলস্বরূপ, নকলকে প্রশ্রয় দেন, খাতায় ভরাট শব্দ দেখলেই নম্বর দেন- কারণ তিনি জানেন, তার সন্তানের দুধের টাকাটা এই পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করছে।

শুধু কি এমপিও শর্ত? বোর্ড কর্তৃপক্ষ খাতা মূল্যায়নের সময় মৌখিক নির্দেশ দেন- “যেভাবেই হোক, সবাইকে পাশ করাতে হবে।” অর্থাৎ, রাষ্ট্র নিজেই শিক্ষকদের দিয়ে ‘অনৈতিকতা’র বাস্তবায়ন করায়, আবার তারাই সবচেয়ে বেশি দোষারোপের শিকার হন। এ যেন চোর বানিয়ে আবার থানায় সোপর্দ করা।

যে শিক্ষার্থী খাতায় কিছু লিখলেই পাশ করে যায়, সে কেন রাত জেগে পড়বে? সে কেন কষ্ট করে পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করবে? আজকের জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থীরাও দিনে দুই ঘণ্টা পড়াশোনায় সময় দেয় না- এটাই আমাদের তথাকথিত ‘সফলতা’র প্রতিচ্ছবি।

সমাধান কোথায়?
প্রথমত, ‘পাশ-ফেল নির্ভর এমপিও’ নামের এই কালো আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। শিক্ষককে নিশ্চিত করতে হবে- তিনি সত্যিকারের শিক্ষাদান করবেন, ফলাফল যাই হোক না কেন, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তাকে বলতে হবে- “তুমি নকল রোধ করো, রাষ্ট্র তোমার পাশে থাকবে।”

দ্বিতীয়ত, জাতীয় রাজনীতিকে শিক্ষিত নেতৃত্বের অধীন করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত- প্রতিটি জনপ্রতিনিধির জন্য ন্যূনতম গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করতে হবে। গণ্ডমূর্খ, দখলবাজ, সুবিধাবাদীরা যেন আর রাজনীতির নামে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে না পারে। তবেই ছাত্ররাজনীতি হবে আদর্শিক, দেশপ্রেমভিত্তিক। নইলে রাজনীতি হবে শিক্ষার শত্রু, জাতির দুর্ভাগ্য।

রাষ্ট্র যদি চায়, শিক্ষক আবার আদর্শবান হোক- তবে তাকে আগে নিজের মুখ আয়নায় দেখতে হবে। কারণ পচন শুরু হয়েছে উপর থেকে, নিচে নয়।

শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি এগোয় না- এ সত্য আমরা মুখে বলি, কিন্তু কাজে দেখাই না। এই আত্মপ্রবঞ্চনার সময় শেষ। এখনই যদি শিক্ষাকে মুক্ত করে না তোলা হয় রাষ্ট্রীয় শর্ত আর সংকীর্ণ রাজনীতির শৃঙ্খল থেকে, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ কেবল ব্যর্থতা আর মেধাশূন্য নেতৃত্বে ভরা এক বিষাদগ্রস্ত জাতি হবে।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না