মানুষের প্রকৃত মেধা ও সৌন্দর্য- এক বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ

আলাউল হোসেন

মানুষের সৌন্দর্য ও মেধা বিষয়ক ধারণা মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই নানা পরিপ্রেক্ষিতে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমান সমাজে এই দুটি গুণকে বিচার করা হয় বেশ একপেশেভাবেÑ অ্যাকাডেমিক সাফল্য ও বাহ্যিক চেহারার গণ্ডিতে। পরীক্ষায় কে কত ভালো নম্বর পেল কিংবা কার মুখাবয়ব কতটা ‘আকর্ষণীয়’, সেই মাপকাঠিতে নির্ধারিত হয় সে মেধাবী না অমেধাবী, সুন্দর না অসুন্দর। অথচ বাস্তবতা হলোÑ মানুষের মেধা ও সৌন্দর্য এতোটা সরল ও সীমিত কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

প্রথমত, ‘মেধা’ শব্দটি শুধু পঠন-পাঠনে দক্ষতা বোঝায় না। এটি একটি ব্যাপক ও বহুমাত্রিক ধারণা। হাওয়ার্ড গার্ডনারের ‘গঁষঃরঢ়ষব ওহঃবষষরমবহপবং’ বা বহুবিধ বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের বুদ্ধিমত্তা অন্তত আটটি ভিন্ন ধরনের হতে পারেÑ যেমন ভাষাগত, যৌক্তিক-গাণিতিক, সংগীততত্ত্বীয়, স্থানিক, দেহগত-আন্দোলনজনিত, আন্তঃব্যক্তিক, অন্তর্ব্যক্তিক এবং প্রকৃতিগত বুদ্ধিমত্তা। কাজেই, একজন শিশু হয়তো গাণিতিক সমাধানে দুর্বল, কিন্তু সে হয়তো অসাধারণ শিল্পী, সুরের কারিগর, কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে সংলাপ করতে পারা এক গভীর হৃদয়ের অধিকারী। তাহলে তাকে কেবল নম্বর দেখে অমেধাবী বলা কি যৌক্তিক?

তদ্রূপ, সৌন্দর্য বিষয়েও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে বাহ্যিক চেহারা, গায়ের রঙ, উচ্চতা, শারীরিক গঠন ইত্যাদির মধ্যে। কিন্তু সৌন্দর্য তো মূলত অনুভূতির বিষয়Ñ যা হৃদয়ে ধরা পড়ে, চোখে নয়। চেহারার সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী; সময়ের সঙ্গে তা বিবর্ণ হয়, বিবর্তিত হয়। কিন্তু চরিত্রের সৌন্দর্য, মননের ঔজ্জ্বল্য, মানুষের প্রতি সহানুভূতি—এইসব গুণাবলি মানুষকে করে তোলে প্রকৃত সুন্দর। একজন মানুষের কথা বলার ভঙ্গি, ব্যবহারের কোমলতা, অন্যের দুঃখ বুঝে নেওয়ার ক্ষমতাÑ এসবই এমন এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, যা কোনো আয়নায় প্রতিফলিত হয় না, কিন্তু আত্মায় দাগ কেটে যায়।

সমাজের নানা স্তরেÑ বিদ্যালয়, পরিবার, গণমাধ্যম, এমনকি কর্মক্ষেত্রেÑ একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, যেখানে সফলতা ও স্বীকৃতি কেবল বাহ্যিক মাপকাঠিতে নির্ধারিত হয়। এর ফলে যারা প্রচলিত মানদণ্ডে খাপ খায় না, তারা নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে শেখে। এই মনোভাব আত্মবিশ্বাসহীনতা, হতাশা এবং মানসিক চাপের জন্ম দেয়, যা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।

এখানে সাহিত্য, দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের একটি পরিপূর্ণ চিত্র দিতে পারে। সাহিত্য সবসময় মানুষকে দেখেছে তার অন্তর থেকে, তার অনুভব, সংকট, স্বপ্ন ও আত্মার আলো থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারবার বলেছেন, “সুন্দর সে যে হৃদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত।” সেখানেই নিহিত আছে মানুষের সত্যিকারের পরিচয়। মনোবিজ্ঞান বলছে, মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য তার স্বকীয়তা ও ভিন্নতা মেনে নেওয়া জরুরি। প্রতিটি মানুষই জন্মায় কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে, যা প্রয়োজন যথাযথ অনুধাবন ও পুষ্টির।

অতএব, আমাদের প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। শিশু থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্কÑ সব মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভিন্ন ভিন্ন মেধা ও সৌন্দর্যকে চিনে নেওয়ার শিক্ষা দিতে হবে পরিবারে, বিদ্যালয়ে, সমাজে। প্রতিটি মানুষ যেন নিজেকে তার স্বকীয়তার আলোয় আবিষ্কার করতে পারে, সে পরিবেশ তৈরি করাই হোক আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

একটি ফুল যেমন গন্ধ দিয়ে, একটি তারা যেমন আলো দিয়ে, তেমনি প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব সৌন্দর্য ও মেধার দীপ্তি দিয়ে এই পৃথিবীকে অর্থবহ করে তোলে। আমাদের কাজ সেই দীপ্তিকে উপলব্ধি করা, মূল্য দেওয়াÑ আরো মানবিক, সহানুভূতিশীল ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না