আলাউল হোসেন
শৈশব- একটি শব্দ; যেটি কানে এলেই মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে লাটিম, কানামাছি, বৌচি কিংবা বিকেলের রোদে দৌড়াতে থাকা কিশোরের ছবি। কিন্তু আজকাল সে ছবি যেন বিবর্ণ, অস্পষ্ট। মোবাইল স্ক্রিন আর মোটরবাইকের শব্দ সেই চিত্রপট ছিঁড়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিশু-কিশোরদের জগৎ এখন বন্দী কাচের ভিতর, ডিজিটাল পর্দায়। একদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে অনলাইন গেমের অবিরাম আকর্ষণ- শৈশবের সরলতা ও কৈশোরের সতেজতা হারিয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম উত্তেজনার জগতে।
এই যান্ত্রিক আসক্তির ভয়ংকর প্রভাব পড়ছে শিশুমনে। মানসিক অস্থিরতা, একাকীত্ব, শারীরিক দুর্বলতা আর চোখের সমস্যার পাশাপাশি, তৈরি হচ্ছে এক ভয়ংকর ভবিষ্যৎ। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্মার্টফোনে ডুবে থাকা এই প্রজন্ম ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে বাস্তব জগতের স্বাদ। আর এইসবের মাঝেই আরও একটি ভয়ংকর সঙ্গী এসে হাজির হয়েছেÑ মোটরবাইক। কৈশোরের কাঁধে ভর করে ছুটে চলা বাইক যেন এক মৃত্যুর দৌড় প্রতিযোগিতা।
আজকের শিশুরা জন্মদিনে মোবাইল হাতে পায়, হাতে পায় ঈদের উপহার হিসেবে কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের পুরস্কারস্বরূপ। অথচ সেটাই একসময় হয়ে উঠছে তাদের ধ্বংসের কারণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইন গেম, ইউটিউব ভিডিও, টিকটক রিল- সব মিলিয়ে তারা হারিয়ে ফেলছে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক। শুধু খেলার মাঠ নয়, হারিয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাতা, হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। অবচেতনেই তারা একাকী হয়ে পড়ছে, অধৈর্য হয়ে উঠছে এবং ভয়ংকরভাবে মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে একটি যন্ত্রের ওপর।
একইভাবে, কৈশোরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই অনেক কিশোরের জীবনে নতুন অতিথি হয়ে আসে মোটরবাইক। কিশোরটি ভাবে সে যেন এক স্বাধীন সৈনিক- গতি আর রোমাঞ্চের নেশায় বিভোর। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ববোধও জরুরি। গতি কখনও রক্ষা করে না- তা কেবল শেষ করে দেয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ শীর্ষে। এই পরিসংখ্যান শুধুই সংখ্যা নয়, বরং অসংখ্য ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন, কান্নায় ভেঙে পড়া পরিবার, রক্তাক্ত রাস্তাঘাট আর অকালে থেমে যাওয়া জীবনের গল্প। বিশেষ করে মফস্বলের চিত্র আরও ভয়াবহ। ট্রাফিক তদারকির অভাব, বেপরোয়া গতি, অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের দাপটÑ সব মিলে এক চরম দুঃস্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটছে প্রতিদিন।
প্রতিদিনের খবরের শিরোনামে থাকা ‘এক্সিডেন্টে প্রাণ গেল তরুণের’, ‘স্কুলপড়ুয়া বাইক দুর্ঘটনায় নিহত’- এই সব কিছুর পেছনে যে একেকটি পরিবার ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তা আমরা সহজেই উপেক্ষা করি। অগণিত মা-বাবা আজও সন্তান হারিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেন, “বাইকটা কেন কিনে দিলাম?” অথচ তার আগেই হয়তো সেই সন্তান হুমকি দিয়েছিল- বাইক না পেলে আত্মহত্যা করবে। এই ভয়, এই জিম্মি করে চাওয়া- তা যেন অভিভাবকদের সামনে বিকল্পহীন এক চিত্র তুলে ধরে।
এই অবস্থার হাত থেকে তাদের রক্ষা করা অসম্ভব নয়, বরং প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট, গঠনমূলক কিছু পদক্ষেপ:
প্রথমত, পরিবার থেকেই সচেতনতার সূচনা হওয়া প্রয়োজন। অভিভাবকদের উচিত শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার আগে সেটির সীমাবদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মোবাইল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া এবং সময় পেরিয়ে গেলে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিকল্প হিসেবে শিশুদের খেলাধুলা, গল্পের বই, ছবি আঁকা, সঙ্গীতচর্চার মতো সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে। অভিভাবকরা যদি নিজেরাও প্রযুক্তির আসক্তি থেকে দূরে থাকেন, তাহলে সন্তানদের জন্য একটি ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি হয়। স্মার্টফোন ও বাইকের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করাও একান্ত জরুরি- কেন এটি ক্ষতিকর, তা যুক্তিসহকারে বোঝাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ব্যবহারের বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। স্কুলে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ে মাসিক সচেতনতা ক্লাস চালু করা যেতে পারে, যেখানে শিশুদের শেখানো হবে অনলাইন আসক্তির ক্ষতি, ভার্চুয়াল জগতের সীমাবদ্ধতা এবং বাস্তব জীবনের গুরুত্ব। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করে বিকল্প কার্যক্রম যেমন- বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন, নাটক, খেলাধুলা ইত্যাদি চালু রাখা দরকার, যাতে শিশুরা অফলাইনে নিজেদের প্রকাশের সুযোগ পায়।
তৃতীয়ত, কিশোরদের ক্ষেত্রে মোটরবাইক ব্যবহারের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা জরুরি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ অভিভাবক নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং সন্তানদের মানসিক চাপের কারণে বাইক কিনে দেন। তাদের মতে, যদি রাষ্ট্র একটি বয়সসীমার নিচে মোটরবাইক চালানোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং প্রশাসন তা বাস্তবায়ন করে, তাহলে অভিভাবকরাও সন্তানের আবদার প্রতিহত করতে সক্ষম হবেন। রাষ্ট্রকে অবশ্যই ১৮ বছরের নিচে মোটরবাইক চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু আইন করলেই চলবে না, সেটির প্রয়োগ নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। লাইসেন্সবিহীন বাইক চালালে কেবল চালক নয়, অভিভাবকদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনার নিয়ম প্রণয়ন করা উচিত। মহাসড়কে অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকদের চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে, বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলে, যেখানে ট্রাফিক নজরদারি প্রায় নেই বললেই চলে।
এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো যেতে পারে- টিভি বিজ্ঞাপন, নাটক বা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের ক্ষতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হলে অভিভাবকরাও সচেতন হবেন। একইসঙ্গে সমাজে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে শিশুদের সময় কাটানোর স্বাস্থ্যকর ও গঠনমূলক বিকল্প তৈরি হয়। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লাব, পাঠাগার বা শিশু বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে যেখানে তারা প্রযুক্তি ছাড়া নিজেরাই আনন্দ খুঁজে পাবে।
সবচেয়ে বড় কথা, শিশুকে নিয়ন্ত্রণ নয়- তাকে বোঝানো, ভালোবাসা দিয়ে তার পাশে থাকা এবং ধৈর্য ধরে সঠিক পথ দেখানোই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। স্মার্টফোন ও বাইকের সঠিক ব্যবহার শেখানোই হবে টেকসই নিরাপত্তা- কারণ সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা নয়, সচেতনতা ও বিকল্প চর্চাই পারে শিশুদের রক্ষা করতে।
আমরা চাই না আর একটি মায়ের বুক খালি হোক। আমরা চাই না আর একটি কিশোর তার বাইকের সঙ্গে শেষ যাত্রায় রওনা দিক। তাই এখনই সময়- চোখ খুলে দেখার, সচেতন হওয়ার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ শৈশব ও কৈশোর নিশ্চিত করার। আসুন, আমরা শিশুদের হাতে হাতে তুলে দিই বই, খেলনার গাড়ি, আর মাটির গন্ধে ভরা বিকেল। কিশোরদের হাতে মোটরবাইক নয়- তাদের দিই সাহস, স্বপ্ন, আর জীবনকে উপলব্ধির বোধ।
অভিভাবক, সমাজ, রাষ্ট্র- সবাইকে একত্রিত হয়ে বলতে হবে: “না, আর একটি জীবনও হারাতে দেব না।”
