শিশুর আত্মমর্যাদাবোধ গঠনে সংবেদনশীল যোগাযোগ: একটি মনস্তাত্ত্বিক অন্বেষণ

আলাউল হোসেন

শিশুদের মানসিক বিকাশের ভিত্তি গড়ে ওঠে প্রাথমিক পারিবারিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতার উপর। আত্মমর্যাদাবোধ, যা একজন ব্যক্তির আত্মসম্মান ও আত্মমূল্যায়নের অনুভূতি, তা শিশুকালেই গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সংবেদনশীল যোগাযোগ (Sensitive Communication) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি শুধু শিশুর আবেগ বোঝা নয়, বরং তার প্রতি সহানুভূতি, সম্মান এবং ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার একটি সুস্থ ও মানবিক পদ্ধতি।

সংবেদনশীল যোগাযোগ কী?
সংবেদনশীল যোগাযোগ এমন এক মনোভাবপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী পদ্ধতি, যার মাধ্যমে বড়রা শিশুদের সাথে মমতাপূর্ণ, সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীলভাবে কথা বলেন এবং তাদের অনুভূতিকে স্বীকৃতি দেন। এতে শিশুরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বলে অনুভব করে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি শিশু তার আঁকা ছবিটি দেখিয়ে বলে, “দেখো! আমি একটা গাছ এঁকেছি!”, তখন যদি বড়রা বলেন, “বাহ! খুব সুন্দর! তুমি নিজে আঁকছো? গাছটা অনেক প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে!” — এ ধরনের সাড়া তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

আত্মমর্যাদাবোধের গঠন: মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসন তাঁর মনোবিকাশ তত্ত্বে উল্লেখ করেন, শিশুর জীবনের প্রাথমিক বছরগুলোতে আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা গঠনের বীজ বপিত হয়। শিশু তখন নিজেকে বিশ্বস্ত, সক্ষম ও ভালোবাসার যোগ্য হিসেবে দেখতে চায়। যদি বড়রা তার কথা শোনে, আবেগ বুঝতে চায় এবং ভুল করলে তিরস্কার না করে সহানুভূতি দেখায়, তবে শিশুর আত্মমর্যাদাবোধ দৃঢ় হয়।

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কার্ল রজার্সের ‘Unconditional Positive Regard’ ধারণাটিও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য — শিশু যদি নিঃশর্ত ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা পায়, তবে সে নিজেকে সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলে ভাবতে শেখে।

সংবেদনশীল যোগাযোগের উপাদান
১. সক্রিয় শ্রবণ (Active Listening): শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তার অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করা।
২. নেতিবাচক না হয়ে গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া: “তুমি সবসময় ভুল করো” না বলে “তুমি চেষ্টা করেছো, এবার একটু ভেবে দেখলে আরও ভালো হবে।”
৩. চোখের যোগাযোগ ও শারীরিক স্পর্শ: কোমল দৃষ্টি বা হালকা আলিঙ্গন শিশুকে নিরাপত্তা ও গুরুত্বের অনুভব দেয়।
৪. সমতার ভিত্তিতে কথা বলা: শিশুকে ছোট বা তুচ্ছ মনে না করে, তার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা।

আত্মমর্যাদাবোধ বাড়ানোর ফলাফল
যেসব শিশুর আত্মমর্যাদাবোধ শক্তিশালী, তারা—
সিদ্ধান্ত গ্রহণে আত্মবিশ্বাসী হয়
সামাজিকভাবে সফল হয়
সমস্যা সমাধানে দক্ষ হয়
নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে

পরিবার ও শিক্ষকের ভূমিকা
পরিবার ও শিক্ষকগণ শিশুর জীবনের প্রধান মডেল। যদি তারা সংবেদনশীল যোগাযোগের চর্চা করেন, তবে শিশু সেটাই আত্মস্থ করে। পরিবারের উষ্ণতা ও বিদ্যালয়ের সহানুভূতিশীল পরিবেশ শিশুর আত্মমর্যাদাবোধের জন্য এক অবিচ্ছেদ্য সহায়ক।

শিশুর মানসিক বিকাশে শুধু শারীরিক পরিচর্যা নয়, প্রয়োজন মর্মস্পর্শী সম্পর্ক ও সংবেদনশীল আচরণ। ছোট ছোট কথাবার্তা, সংলাপ ও আচরণের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে বড় ভবিষ্যৎ। একটুকু সহানুভূতি, একফোঁটা ভালোবাসা ও একটু মনোযোগ — এটাই শিশুর আত্মমর্যাদার মজবুত ভিত গড়তে পারে।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না