আলাউল হোসেন
একবিংশ শতাব্দীর শিশু জন্মগ্রহণ করছে একটি ডিজিটাল বাস্তবতায়—যেখানে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ইউটিউব, গেমস ও সামাজিক মাধ্যম তার দৈনন্দিন জীবনের অংশ। প্রযুক্তি একদিকে যেমন জ্ঞানের জগত উন্মুক্ত করছে, তেমনি অন্যদিকে শিশুর মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক বিকাশে সৃষ্টি করছে নতুন চ্যালেঞ্জ। ফলে প্রশ্ন উঠে: কতটা প্রযুক্তি শিশুর জন্য উপকারী? কোথায় প্রযুক্তির সীমারেখা টানা উচিত?
প্রযুক্তি ও শিশুর জীবন: সম্ভাবনা ও সুবিধা:
১. জ্ঞানার্জনের নতুন পথ: ইন্টারনেটভিত্তিক অ্যাপ ও ভিডিও শিশুদের শেখার আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করে। Khan Academy Kids, YouTube EDU, Abacus apps-এর মতো প্ল্যাটফর্মে শিশুরা সহজেই গণিত, ভাষা ও বিজ্ঞানের ধারণা আয়ত্ত করতে পারে।
২. সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি বিকাশ: গ্রাফিক ডিজাইন, অ্যানিমেশন, অনলাইন ড্রয়িং বা গল্প লেখার প্ল্যাটফর্ম শিশুকে নিজের মত প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে।
৩. বিশ্বের সাথে সংযোগ: প্রযুক্তি শিশুকে বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে সহায়তা করে। তারা বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।
বিপর্যয় ও ঝুঁকি: প্রযুক্তি নির্ভরতার ছায়া:
১. স্ক্রিন আসক্তি: অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে শিশুর ঘুমের সমস্যা, রাগ, মনোযোগ ঘাটতি ও উদ্বেগ দেখা দিতে পারে।
২. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: ভার্চুয়াল জগতে অতিরিক্ত মগ্ন শিশু বাস্তব বন্ধুত্ব, আবেগ প্রকাশ ও সহানুভূতির চর্চা থেকে পিছিয়ে পড়ে।
৩. শারীরিক জটিলতা: দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, চোখের ওপর চাপ ও শারীরিক অনুশীলনের অভাব শিশুদের স্থূলতা, চোখের সমস্যা ও হাড়ের গঠনে প্রভাব ফেলতে পারে।
৪. অনিরাপদ কনটেন্টের সংস্পর্শ: যথাযথ অভিভাবকীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকলে শিশু অপ্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট বা অনলাইন হুমকির মুখোমুখি হতে পারে।
ভারসাম্য রক্ষার কৌশল:
১. সময় নির্ধারণ: শিশুর বয়সভিত্তিক স্ক্রিনটাইম নির্ধারণ জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, ২-৫ বছর বয়সে দিনে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা মানসম্মত কনটেন্ট দেখার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা।
২. সহযোগী ব্যবহার: শিশুকে প্রযুক্তির সাথে একা ছেড়ে না দিয়ে মা-বাবা বা বড়রা তার সাথে বসে কনটেন্ট দেখা বা শেখায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।
৩. শিখনমূলক অ্যাপ ও গেম বেছে নেওয়া: শুধুমাত্র বিনোদন নয়, এমন অ্যাপ বা গেম নির্বাচন করা উচিত যা শেখার আগ্রহ তৈরি করে।
৪. টেক ফ্রি টাইম: পরিবারের নিয়মিত ‘স্ক্রিন-মুক্ত সময়’ নির্ধারণ—যেমন রাতের খাবার, গল্পের সময় বা সাপ্তাহিক ঘোরাফেরা—শিশুকে ভারসাম্য শিখতে সহায়তা করে।
৫. প্রকৃতি ও খেলার সংযোগ: শিশুকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করা, বাইরে খেলা, হাতের কাজ ও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা দরকার।
পিতা-মাতা ও শিক্ষকের ভূমিকা:
শিশুর প্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন পিতা-মাতা ও শিক্ষক। তাঁদের উচিত—
প্রযুক্তি ব্যবহারে নিজেই দায়িত্বশীল মডেল হওয়া
নিয়মিত আলোচনা করে শিশুর অভিজ্ঞতা জানা
প্রযুক্তির পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন ও আবেগগত সম্পর্ক জোরদার করা
প্রযুক্তি এক দৈত্য নয়, আবার পরিপূর্ণ বন্ধুও নয়। এটি নির্ভর করে আমরা কিভাবে এটি ব্যবহার করছি। শিশুর হাতে প্রযুক্তি থাকুক, তবে হোক তা সংবেদনশীল দিকনির্দেশনায় ও ভারসাম্যের আলোকে পরিচালিত। কারণ আজকের শিশুই আগামী সমাজের নেতৃত্ব দেবে — এবং সেই সমাজ হবে প্রযুক্তিনির্ভর হলেও মানবিকতায় পূর্ণ।