ভুল থেকে শেখা, প্রশংসায় বেড়ে ওঠা: শিশুর ইতিবাচক আচরণ গঠনের পথ

আলাউল হোসেন

শিশুরা জন্মগতভাবেই কৌতূহলী, আবেগপ্রবণ ও শেখার আগ্রহে পূর্ণ। বেড়ে ওঠার পথে তারা ভুল করে, অজানা জগৎকে আবিষ্কার করতে গিয়ে কখনো সীমা অতিক্রম করে। এই ভুলগুলোই তাদের শেখার ভিত্তি হতে পারে—যদি আমরা তা গ্রহণ করতে পারি ধৈর্য, সহানুভূতি এবং প্রশংসার আলোকে। শিশুর ইতিবাচক আচরণ গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন এক সহায়ক পরিবেশ, যেখানে ভুল করা অপরাধ নয়, বরং শেখার সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়।

শিশুর ভুল: শাস্তি নয়, শেখার সম্ভাবনা
শিশুর ভুল বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ প্রাকৃতিক এবং বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক।
যেমন—একটি তিন বছরের শিশু যদি রঙ দিয়ে দেয়ালে আঁকে, সেটা তার সৃজনশীলতার প্রকাশ। এই আচরণ শাস্তি নয়, বরং ইতিবাচক নির্দেশনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুরা যখন ভুল করে, তখন তারা পরীক্ষামূলকভাবে শেখার চেষ্টা করছে। সেই সময় যদি বড়রা রাগ করে, গাল দেয় বা অপমান করে, তবে শিশুর আত্মমর্যাদাবোধ ভেঙে যায় এবং সে ভয়ভিত্তিক আচরণ গড়ে তোলে।

প্রশংসা: ইতিবাচক আচরণের সারথি
প্রশংসা মানে শুধুই বাহবা নয়, বরং সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ইতিবাচক আচরণের স্বীকৃতি দেওয়া। এটি শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তাকে আরও ভালো করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।

ব্যবহারিক প্রশংসা: “তুমি খুব সুন্দর করে খেলনার সবকিছু গুছিয়ে রেখেছো, দারুণ কাজ!”

প্রক্রিয়া-ভিত্তিক প্রশংসা: “তুমি অনেক চেষ্টা করেছো, সেটা দারুণ! এভাবেই শিখে ফেলা যায়।”

অভ্যন্তরীণ অনুপ্রেরণা জাগানো প্রশংসা: “তুমি যখন বন্ধুকে সাহায্য করো, সেটা তোমাকে কেমন লাগে?”

ইতিবাচক আচরণ গঠনের কৌশল
১. ভুলের পর আলোচনার সময় দিন:
“তুমি কেন এটা করেছো?” – এভাবে প্রশ্ন না করে বলা যায়, “তুমি কী ভাবছিলে যখন এটা করলে?”
এতে শিশু আত্মসমালোচনার সুযোগ পায়।

২. মডেলিং বা উদাহরণ তৈরি করা:
শিশুরা দেখে শিখে। বড়রা যদি সহানুভূতিশীল, ধৈর্যশীল ও সম্মানজনক আচরণ করেন, শিশুরাও তা অনুসরণ করে।

৩. নিয়ম তৈরি ও ব্যাখ্যা করা:
“ঘুমানোর আগে খেলনা গুছিয়ে রাখলে ঘর পরিষ্কার থাকে, আর তুমি সকালে সহজে খুঁজে পাবে।” — এই ধরনের যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যায় শিশুর আচরণ উন্নত হয়।

৪. নিয়মিত ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া:
ছোট ছোট ভালো কাজের প্রশংসা করুন — হাত ধোয়া, বই গুছানো, সহপাঠীর প্রতি সদাচরণ — এসব আচরণের স্বীকৃতি শিশুর ইতিবাচক প্রবণতা বাড়ায়।

অভিভাবকের ভূমিকা
একজন সচেতন অভিভাবক জানেন, শিশু পারফেক্ট হতে পারে না, কিন্তু প্রতিটি ভুলই তার জন্য শেখার একটি সিঁড়ি। এজন্য—

ধৈর্য বজায় রাখুন
শিশুর অনুভূতির মূল্য দিন
তাকে বোঝান, শাস্তি নয় — ভালোবাসা দিয়েই শেখানো যায়

ভুল থেকে শেখার সুযোগ এবং সময়োচিত প্রশংসা শিশুর ভিতরে আত্মবিশ্বাস, সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলে। তার মধ্যে জাগে ইতিবাচক আত্মপরিচয়। শিশুর ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরি হয় আজকের ছোট ছোট প্রতিক্রিয়া ও আচরণের মাধ্যমে। সুতরাং, আমাদের প্রত্যেকের উচিত—শিশুর ভুলকে শেখার উপায় এবং প্রশংসাকে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা হিসেবে তুলে ধরা।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না