শ্রেণিকক্ষে সহানুভূতি ও উৎসাহ: শেখার আগ্রহ বাড়ানোর মূল চাবিকাঠি

আলাউল হোসেন

একটি শ্রেণিকক্ষ শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক শেখার স্থান নয়—এটি হওয়া উচিত ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং আত্মবিশ্বাস গঠনের প্রাণবন্ত পরিবেশ। শিশু কিংবা কিশোর বয়সে শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষকের নির্দেশনার উপর নির্ভর করে, তেমনি তার আচরণ, সহানুভূতি এবং উৎসাহই হয়ে ওঠে শেখার গভীরতম অনুপ্রেরণা। গবেষণা বলছে, এক অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহানুভূতিশীল ও উৎসাহদায়ক শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার্থীর শেখার আগ্রহ বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে।

সহানুভূতির প্রভাব: শ্রেণিকক্ষের আবেগীয় আবহ
সহানুভূতি মানে শুধু সহানুভূতিশীল মনোভাব নয়, বরং শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থাকে বুঝে, সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানানো।
যেমন: কেউ ভুল করলে তিরস্কার না করে বলা, “তুমি চেষ্টাটুকু করেছো, এটা গুরুত্বপূর্ণ। এবার একসাথে বুঝে নেই।”

কোনো শিক্ষার্থী মনমরা থাকলে তার পাশে বসে বলা, “তুমি ঠিক আছো? আজ তোমার মনটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে।”

এই ছোট ছোট সহানুভূতির কাজ শিশুকে নিরাপদ বোধ করায়, যা শেখার জন্য এক অনিবার্য আবশ্যকতা।

উৎসাহ: আত্মবিশ্বাস ও আগ্রহের পাথেয়
শিক্ষকের উৎসাহ শিক্ষার্থীর জন্য হয় যেন নিরব সহযোদ্ধা। এটি—
আত্মবিশ্বাস বাড়ায়
ভুলকে ভয় না পেয়ে শেখার পথ করে দেয়
একঘেয়েমি কাটিয়ে শিখনকে করে আনন্দময়

উদাহরণস্বরূপ:
একজন শিক্ষার্থী যদি গণিতে দুর্বল হয়, এবং শিক্ষক বলেন, “তুমি যেভাবে ধাপে ধাপে চিন্তা করছো, সেটাই তো সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার শুরু।” — এই কথাটি তার মনে গভীর ছাপ ফেলতে পারে।

সহানুভূতি ও উৎসাহ: সম্মিলিত প্রয়োগ
যেখানে সহানুভূতি শিক্ষার্থীর আবেগ বোঝে, উৎসাহ সেখানে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখায়। এই দুটি গুণ মিলে তৈরি করে এক ‘ইমোশনালি সেফ’ ক্লাসরুম—যেখানে:
শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে ভয় পায় না
প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি হয়

শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ
শ্রেণিকক্ষে বাস্তব প্রয়োগের কিছু কৌশল
১. ‘না’ না বলে ‘কিভাবে হ্যাঁ’-এর পথ দেখানো:
❌ “তুমি এটা পারবে না।”
✅ “চেষ্টা করো, আমি পাশে আছি।”

২. রিফ্লেক্টিভ শ্রবণ:
শিক্ষার্থী কিছু বললে সেটা শুধু শুনে না রেখে তা ফেরত বলা।
“তুমি বলছো এই অংশটা বোঝা যায়নি, তাই না? ঠিক আছে, আবার ব্যাখ্যা করি।”

সবার ছোট জয়কে স্বীকৃতি দেওয়া:
শ্রেণির সকল স্তরের শিক্ষার্থীদের অর্জন উদযাপন করা—কারো লেখার হাত ভালো, কারো কথার ধরন আকর্ষণীয়, কারো মনোযোগ উন্নত হয়েছে — এসবকে প্রশংসা করা।

ইমোশন চেক-ইন বা ‘Feelings Chart’ ব্যবহার:
প্রতিদিনের শুরুতে ১ মিনিটের মধ্যে শিক্ষার্থীরা বোঝায় তারা কেমন বোধ করছে — এতে শিক্ষক সহজেই বুঝতে পারেন কার বাড়তি সহানুভূতি দরকার।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের দক্ষতা যেমন জরুরি, তেমনি আবেগগত বোঝাপড়াও প্রয়োজনীয়। সহানুভূতি এবং উৎসাহ শিক্ষার্থীর মনের বন্ধ দরজাগুলো খুলে দেয়। এমন একটি শ্রেণিকক্ষ যেখানে ভুলের ভয় নেই, যেখানে শেখার আনন্দ আছে—সেই পরিবেশেই গড়ে ওঠে আগামীর আত্মবিশ্বাসী, মানবিক ও চিন্তাশীল নাগরিক।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না