আলাউল হোসেন
“বড়রা যা করে, ছোটরা তা শেখে”—এই প্রবাদটি নিছক কোনো প্রবচন নয়, বরং শিশুর মনস্তত্ত্বের গভীর সত্য। শিশুরা যতটা না কথায় শেখে, তার চেয়েও বেশি শেখে দেখে, অনুকরণ করে। তাই বড়দের আচরণই হয়ে ওঠে তাদের শেখার সবচেয়ে শক্তিশালী পাঠ্যবই। একজন অভিভাবক, শিক্ষক বা বড় ভাই–বোনের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি প্রতিক্রিয়া শিশুর মনে এক একটি আদর্শের চিহ্ন এঁকে দেয়।
শিশুর শেখার প্রক্রিয়ায় অনুকরণ
শিশুরা জন্মগতভাবেই অনুকরণপ্রবণ।
একটি শিশু তার মায়ের মুখের ভাষা, চোখের অভিব্যক্তি ও হাতের ভঙ্গি অনুকরণ করেই কথা শেখে।
বাবা রাস্তায় ট্রাফিক আইন মানলে সন্তানও নিয়ম মানার গুরুত্ব শেখে।
শিক্ষক শ্রদ্ধার সাথে কথা বললে শিক্ষার্থীও ভদ্রতা রপ্ত করে।
মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট বান্দুরার “Social Learning Theory” অনুসারে, শিশুরা ‘মডেলিং’ এর মাধ্যমে শেখে—তারা দেখে, অনুকরণ করে এবং পরে সেই আচরণ গ্রহণ করে।
বড়দের আচরণ: শিক্ষা না, দৃষ্টান্ত
কথা দিয়ে যেমন শেখানো যায়, তেমনি কথার সাথে মিল না থাকলে তা হয়ে পড়ে অর্থহীন। যেমন:
আপনি যদি বলেন “সৎ হও”, কিন্তু সন্তান আপনাকে অন্যের সামনে মিথ্যা বলতে দেখে, তবে সে শেখে বাস্তবে মিথ্যাই টিকে থাকার উপায়।
আপনি যদি স্বীকার করেন, “আমি ভুল করেছি”, তবে শিশু শেখে—ভুল স্বাভাবিক এবং তা স্বীকার করাও সাহসের পরিচয়।
শিক্ষা তখনই কার্যকর হয়, যখন তা আচরণের সাথে মিল রেখে প্রকাশ পায়।
আচরণের শক্তি: শিশুর জীবনের মূল ভিত
১. আত্মমর্যাদাবোধ গড়ে তোলে:
বড়রা যদি শিশুকে সম্মানের সাথে কথা বলে, তার মতামত গুরুত্ব দেয়—তবে সে নিজেকে মূল্যবান ভাবতে শেখে।
২. নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ জন্মায়:
বাবা-মা বা শিক্ষক যদি প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করে দেখান, তাহলে শিশুও নিজের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে শেখে।
৩. সহমর্মিতা ও মানবিকতা তৈরি হয়:
কোনো অসুস্থ আত্মীয়কে সময় দেওয়া, প্রতিবেশীকে সাহায্য করা—এই ছোট ছোট উদাহরণ শিশুর মধ্যে বড় মূল্যবোধ গড়ে তোলে।
কীভাবে বড়রা আদর্শ হতে পারেন?
নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন: রাগ বা বিরক্তির মুহূর্তে কেমন আচরণ করছেন, সেটা শিশুর শেখার একটি বড় দৃষ্টান্ত।
সততা ও দায়িত্ব পালন করুন: প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, সময় মেনে কাজ করা শিশুকে দায়িত্বশীল করে তোলে।
বিনয়ের অনুশীলন করুন: আপনি যদি “ধন্যবাদ” বা “দুঃখিত” বলতে কুণ্ঠাবোধ না করেন, তবে শিশুও শিখবে নম্রতা।
শিশুর সামনে প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতা দেখান: ফোনে অতিরিক্ত সময় না দিয়ে বই পড়া বা কথা বলার সময় মনোযোগ দেওয়া শিশুকে সামাজিক দক্ষতা শেখায়।
শিশুরা আমাদের প্রতিফলন। তারা আমাদের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখে, আমাদের মনোভাব দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করে। তাই তাদের শেখাতে হলে আগে আমাদের নিজেকেই গড়তে হবে। আচরণে জ্ঞানের আলো না থাকলে উপদেশ অন্ধকারেই হারিয়ে যায়। শিশুর চোখে বড়দের আদর্শ হয়ে ওঠার একমাত্র উপায়—নিজেই হতে হবে সেই মানুষ, যাকে দেখে শেখা যায়।