শিক্ষায় মুখস্ত বিদ্যার পুনর্মূল্যায়ন: সৃজনশীলতা শিকড় সন্ধান

আলাউল হোসেন

আজকের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় “সৃজনশীলতা” এক জনপ্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত শব্দ। পাঠ্যক্রম, পাঠদান পদ্ধতি, এমনকি মূল্যায়ন কাঠামোতেও এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। শিশুর চিন্তার স্বাধীনতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে তোলার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সৃজনশীলতার নামে আমরা কি একটি অপরিহার্য শিক্ষাধাপকে অযথা উপেক্ষা করছি না? বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষায় ‘মুখস্তবিদ্যা’কে অবজ্ঞার প্রবণতা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের শিকড় কেটে ফেলার নামান্তর নয়?

মুখস্তবিদ্যা: ভুল বোঝাবুঝির শিকার
সমাজে আজ ‘মুখস্ত’ শব্দটি যেন এক নেতিবাচক অভিধা বহন করে। অভিভাবক, শিক্ষক এমনকি নীতিনির্ধারকরাও মনে করেন, মুখস্ত করাকে উৎসাহ দেওয়া মানেই শিক্ষার্থীর সৃজনশীল বিকাশ রুদ্ধ করা। অথচ শিক্ষামনোবিজ্ঞান ও শিশুবিকাশ বিষয়ক গবেষণা ভিন্ন চিত্রই তুলে ধরে।

শিশুমনের ধরন ও শেখার প্রাথমিক স্তর
শিশুমন ঠিক যেন একটি সাদা ক্যানভাস, যা সহজেই যেকোনো রঙে রাঙানো যায়। জীবনের প্রথম দশ বছর—“স্নায়বিক নমনীয়তার শ্রেষ্ঠ সময়”—এই সময়েই শিশু সবচেয়ে দ্রুত ও গভীরভাবে তথ্য গ্রহণ করতে পারে। ভাষা, সংখ্যা, ছন্দ, সামাজিক রীতিনীতি, এমনকি সংবেদনশীলতা গঠনের সূচনা ঘটে মুখস্তবিদ্যার মাধ্যমেই।

গবেষণার আলোকে মুখস্ত বিদ্যার গুরুত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ড. উইলিয়াম রসিন তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় মৌলিক জ্ঞান অর্জনের পেছনে মুখস্তবিদ্যার ভূমিকা অপরিহার্য। ফিনল্যান্ডের মতো উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থাতেও মুখস্ত শেখার চর্চা রয়েছে, তবে তা আনন্দময় ও প্রাসঙ্গিক উপায়ে। একটি সমীক্ষায় (২০২১) দেখা গেছে—যেসব শিক্ষার্থী ছড়া, কবিতা ও ধর্মীয় শ্লোক মুখস্থ করতে পারছে, তাদের শ্রবণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে প্রায় ৩০% বেশি।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণি পাশ করা প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী মৌলিক গণিত করতে পারে না এবং ৩৫% শিক্ষার্থী ইংরেজিতে সঠিক বাক্য গঠন করতে অক্ষম। এটি প্রমাণ করে, মুখস্তবিদ্যার অপব্যবহার নয়, বরং এর অবহেলাই শিক্ষার্থীদের ভিত্তি দুর্বল করে তুলছে।

মুখস্তবিদ্যা বনাম সৃজনশীলতা: একটি কৃত্রিম দ্বন্দ্ব
আমরা প্রায়ই মুখস্তবিদ্যা ও সৃজনশীলতাকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করাই। বাস্তবতা হলো, এই দুইটি পরস্পর-পরিপূরক। একটি ছড়া মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শিশু শুধু ছন্দ নয়, রূপক, অলংকার ও অনুভব করতে শেখে। এই প্রক্রিয়াই ভবিষ্যতের বিশ্লেষণী মননের ভিত্তি রচনা করে।

মুখস্ত বিদ্যার সৃজনশীল প্রয়োগ: কয়েকটি দৃষ্টান্ত
গাণিতিক গুণ-ভাগের সূচিপত্র মুখস্থ থাকলে জটিল সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব।

ইতিহাসের সাল-তারিখ মনে থাকলে ঘটনাবলির পর্যালোচনা সহজ হয়।

ব্যাকরণীয় নিয়ম মুখস্থ থাকলে সাহিত্য বিশ্লেষণ আরও গভীর হয়।

সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার মুখস্থ থাকলে শিশুর রচনাশক্তি ও ভাবপ্রকাশে দক্ষতা বাড়ে।

শিক্ষার বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের প্রাথমিক পর্যায়ের বহু শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও বাস্তব দক্ষতার দিক থেকে পিছিয়ে। সৃজনশীল প্রশ্নে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ—তাদের মনে প্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার নেই। মুখস্ত জ্ঞানের অভাবেই তারা প্রশ্নের প্রকৃতি বুঝে উঠতে পারে না।

আনন্দময় মুখস্ত শেখা সম্ভব
মুখস্ত বিদ্যার চর্চা মানেই যে কঠিন মুখ গুঁজে থাকা, তা নয়। গান, নাটিকা, গল্প, ছড়া, গেইম কিংবা অ্যাপসের মাধ্যমে শিশুরা আনন্দের সঙ্গেই শেখে। ইংরেজি অক্ষর শেখানোর জনপ্রিয় “ABC Song” এক ধরনের মুখস্ত শেখার কার্যকর উপায়।

অভিভাবক ও শিক্ষকের যৌথ দায়িত্ব
অনেক অভিভাবক মনে করেন—মুখস্ত না করে বুদ্ধিমান হওয়া সম্ভব। আবার অনেক শিক্ষক মুখস্ত চর্চাকে সময়সাপেক্ষ মনে করে এড়িয়ে যান। বাস্তবতা হলো, শিশুদের শেখাতে হবে কীভাবে মুখস্থ করতে হয় বোঝার ভিত্তিতে, প্রয়োগের উদ্দেশ্যে।

নীতিনির্ধারকদের ভাবনার প্রয়োজন
পাঠ্যক্রম প্রণয়নে এমন ভারসাম্য জরুরি, যেখানে মুখস্ত ও সৃজনশীল উভয় প্রক্রিয়ার সহাবস্থান থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষা নীতিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা উচিত যে, মৌলিক জ্ঞান অর্জনের প্রথম ধাপে মুখস্তবিদ্যা অপরিহার্য।

মুখস্ত বিদ্যা ও সৃজনশীলতা কোনোভাবেই একে অপরের বিরোধী নয়। বরং সঠিক সময়ে, উপযুক্ত পদ্ধতিতে মুখস্ত শেখা শিশুর ভবিষ্যৎ বোধ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার ভিত্তি গড়ে দেয়। একটি গাছ ফল দিতে হলে যেমন তার শিকড় মজবুত হতে হয়, তেমনি শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্যও মুখস্তবিদ্যা এক অনিবার্য ভিত্তি। সময় এসেছে এই ভুল দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে মুখস্তবিদ্যার মর্যাদা ফিরিয়ে আনার—বোধের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না