অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন পুঁজিবাজার কি ঘুরে দাঁড়াবে না?

আলাউল হোসেন

বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র যদি বিচার করি, তাহলে একটি অদ্ভুত অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে—একদিকে দেশের রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও কৃষি-শিল্প খাত ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, অন্যদিকে দেশের পুঁজিবাজার যেন এক অনন্ত অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের হতাশা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের টিকার স্ক্রিনে প্রতিদিন লাল রঙের আধিপত্য দেখা যায়, পত্রিকায় পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সংবাদ মানেই হতাশার ছাপ, আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মুখে ঘোর অন্ধকার। অর্থনীতি যখন খানিকটা স্থিতিশীল হচ্ছে, তখন পুঁজিবাজার কেন দিনকে দিন অবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে?

এখানেই এক ভয়াবহ প্রশ্ন উঠে আসে—বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কি মূল অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে? পুঁজিবাজার যেখানে একটি দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশের প্রতিচ্ছবি হওয়ার কথা, সেখানে আমাদের পুঁজিবাজার যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার চিত্র আঁকছে। এমনকি এটি এখন দেশের সমৃদ্ধির পথের প্রতিবিম্ব নয়, বরং আস্থাহীনতা, দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং করপোরেট অসততার এক গাঢ় প্রতিচ্ছবি।

বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বারবার আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং তা কেবলমাত্র বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দুর্বলতা নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও নিয়ন্ত্রণের অভাব। ১৯৯৬ সালের ধস কিংবা ২০১০ সালের পতন—দুই ঘটনার মধ্যেই একটি মিল রয়েছে, সেটি হচ্ছে—সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত হওয়ার ট্র্যাজেডি। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া এখনো বিনিয়োগ মানসিকতায় ঘূর্ণিপাক সৃষ্টি করে রেখেছে।

পুঁজিবাজারে বর্তমান যে অবস্থা, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে মৌলিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ কোম্পানিরই নেই দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, নেই আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের স্বচ্ছতা, নেই শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি দায়বদ্ধতা। এমনকি অনেক কোম্পানি বছরের পর বছর ধরে কোনো লভ্যাংশ দেয় না, অথচ তারা বাজারে উচ্চমূল্যে লেনদেন করে যায়। এই অবস্থায় নতুন বিনিয়োগকারীদের পক্ষে বাজারে আস্থা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

আরেকটি বড় সংকট হলো আইপিও ব্যবস্থার দুর্বলতা। যে কোনো কোম্পানি যখন বাজারে আসে, তখন তার আর্থিক তথ্য যাচাই-বাছাই করার কথা বিএসইসি’র, কিন্তু বহু সময় দেখা যায়, অতিমূল্যায়িত কোম্পানি শেয়ারবাজারে প্রবেশ করে এবং প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে। পরে সেই কোম্পানিগুলো লোকসান গুনতে গুনতে একসময় প্রায় শূন্যমূল্যে দাঁড়ায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, আর আস্থা ভেঙে পড়ে পুরো বাজার কাঠামোর।

এতসব কিছুর মূলে রয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার দক্ষতার অভাব এবং প্রায়শই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। পুঁজিবাজারের মতো সংবেদনশীল জায়গায় বারবার রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় বাজারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। এই অনিশ্চয়তা থেকে বিনিয়োগকারীরা বারবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবার যারা থাকেন, তারা অধিকাংশই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অভাব বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। যখন বাজার ওঠে, তখন অসংখ্য বিনিয়োগকারী হুড়োহুড়ি করে ঢুকে পড়ে, আর যখন নামে, তখন সবাই একসাথে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে—ফলে বাজারে স্থিতিশীলতার পরিবর্তে দেখা দেয় হঠাৎ উত্থান-পতনের প্রবণতা।

অন্যদিকে, সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও পুঁজিবাজারকে জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। রপ্তানি, কৃষি, শিল্পায়ন, অবকাঠামো খাতে যতটা প্রণোদনা ও পরিকল্পনা রয়েছে, পুঁজিবাজার যেন তার ছায়াতলে থেকেও অবহেলিত। অথচ একটি সবল ও সুশাসিত পুঁজিবাজার অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হতে পারে। এ বাজারের মাধ্যমে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মূলধন সংগ্রহ করতে পারে, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি হতে পারে এবং সাধারণ মানুষও তাদের সঞ্চয়কে উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ করতে পারে।

এই অব্যবস্থার মধ্যেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, পুঁজিবাজারে প্রতিনিয়ত নতুন বিনিয়োগকারী আসছে, অনেকে স্বপ্ন নিয়ে আসছে ভবিষ্যৎ গড়ার, কেউবা আর্থিক নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তারা বোঝে—এ বাজার স্বপ্নের জায়গা নয়, বরং এটি ভাগ্যনির্ভর এক জুয়া। এই ভাবনা থেকেই বিনিয়োগকারীরা হয় ক্ষতির পর বাজার ছাড়ে, নয়তো শেয়ার হোল্ড করে অপেক্ষার প্রহর গোনে। কারো কারো সেই অপেক্ষা চলে বছরের পর বছর। অথচ উন্নত দেশগুলোর পুঁজিবাজারে লংটার্ম ইনভেস্টমেন্ট বা ডিভিডেন্ড ইনকামের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত অর্থনীতি গড়ে ওঠে, সঞ্চয় বাড়ে, অবসর পরিকল্পনা তৈরি হয়।

প্রশ্ন হলো—এই অবস্থায় কি বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে না? অবশ্যই পারে, যদি সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রথমেই দরকার বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যা কেবল নিয়মিত আর্থিক প্রতিবেদন ও কোম্পানির তথ্যপ্রবাহ দ্বারা সম্ভব নয়—এটি নিশ্চিত করতে হবে কঠোর আইন প্রয়োগ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, বাজারে দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি বাড়াতে হবে, আর সে জন্য চাই কর কাঠামোর সংস্কার, প্রণোদনা ও নিরাপত্তার আশ্বাস। তৃতীয়ত, পুঁজিবাজারে নতুন পণ্য যেমন কর্পোরেট বন্ড, সরকারি বন্ড, ডেরিভেটিভস, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড ইত্যাদি চালু করে বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করতে হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের পছন্দের পরিসর বাড়বে এবং ঝুঁকি বণ্টনও সহজ হবে।

একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হলো—বিনিয়োগ শিক্ষা। পুঁজিবাজার সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এখনো অপর্যাপ্ত তথ্য ও ভুল ধারণার মধ্যে রয়েছে। অনেকেই জানেন না, কীভাবে কোম্পানি বিশ্লেষণ করতে হয়, মৌলিক ভিত্তি কীভাবে বোঝা যায়, বা ঝুঁকি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ জন্য দরকার গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ও বিএসইসির যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী বিনিয়োগ সচেতনতা ক্যাম্পেইন।

অর্থনীতি থেকে যখন কোনো একটি উপখাত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন সেটি সিস্টেমেটিক রিস্ক সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বর্তমানে ঠিক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে এটি যদি ঘুরে না দাঁড়ায়, তবে ভবিষ্যতে এ দেশের করপোরেট সেক্টরে বৈধ মূলধনের প্রবাহ কমে আসবে, বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমবে, এবং অর্থনীতির ভিত দুর্বল হয়ে পড়বে। আমরা যদি চাই একটি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি, তাহলে একটি সক্রিয়, স্বচ্ছ ও শক্তিশালী পুঁজিবাজার আবশ্যক। এ বাজার কেবল মুনাফার জায়গা নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের হাতিয়ার।

শেষ কথা হলো—বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ রাখে, তবে সময় খুবই সীমিত। দেরি হলে বাজারে ভরসা ফেরানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই এখনই প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত, কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি নীতি কাঠামো। তবেই হয়তো এ বাজার আবারও হবে জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অনন্য সোপান।

আলাউল হোসেন: কবি-গীতিকার, সাংবাদিক ও শিক্ষক; সর্বোপরি একজন নন্দনচেতন মানুষ। শিক্ষাব্রতী, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠাতা, লিটলম্যাগ সম্পাদক, গবেষক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বে নীরবে অথচ দৃপ্তপদে গড়ে তুলেছেন পাবনার সাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্যিক ভিত্তি। শুধু লেখেন না, মফস্বলের লেখকদের পথ দেখান; ছোটদের হাত ধরে নিয়ে যান সাহিত্যের দ্রুপদী উঠোনে। “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে” স্নাতকোত্তর। ‌‌“আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট: গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিস ফর ইমপ্লিমেন্টেশন” বিষয়ে ডিপ্লােমা কোর্স সম্পন্ন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ভার্ড এক্স (অনলাইন প্রোগ্রাম) থেকে। পাবনার মাশুন্দিয়া-ভবানীপুর ডিগ্রি কলেজে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না