আলাউল হোসেন
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সারা দেশে আলোচনার ঝড় উঠেছে। পাসের হার, জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা, এমনকি শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা—সবচেয়ে উদ্বেগজনক রূপে ধরা দিয়েছে এবারের ফলাফলে। গত ১৬ বছরে এটিই সবচেয়ে কম পাসের হার। গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা সংখ্যায় প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থীর অনুত্তীর্ণ হওয়ার শঙ্কা তুলে ধরে। একই সঙ্গে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৩ হাজার ৯৭ জন কম শিক্ষার্থী। ফলে বিগত বছরগুলোতে যে ধারাবাহিক উন্নতির চিত্র আমরা দেখে এসেছি, এবার সেখানে পড়েছে এক অস্বস্তিকর ছেদ।
তবে প্রশ্ন উঠেছে—এই ফলাফল কি সত্যিই বিপর্যয়, না কি এটা শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের গড়াপিটা সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে সঠিক মূল্যায়নের দিকে একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ? কারণ, ফলাফলের এই বড় ধরনের পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত ও নীতিগত সংশোধন, যা এতদিন ধরে অপারদর্শিতার আড়ালে চাপা পড়ে ছিল।
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যেখানে গত বছর ছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। এটা নিঃসন্দেহে এক বিশাল ধস। তবে এই ধস এক দিনে তৈরি হয়নি। বহু বছর ধরে উদার মূল্যায়নের নামে খাতা দেখে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থীর অপ্রাসঙ্গিক উত্তরে নম্বর দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া, ভেন্যু কেন্দ্রভিত্তিক ‘সহানুভূতির নম্বর’ বিতরণ এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন—এসবই একদিন না একদিন থামার প্রয়োজন ছিল।
গত এক যুগে আমরা দেখেছি, প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসিতে পাসের হার ও জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। শিক্ষকেরা খাতা দেখে নম্বর বাড়িয়ে দিচ্ছেন, বোর্ড থেকে মৌখিক নির্দেশ আসছে “যা লিখেছে কিছু একটা দিলেই নম্বর দিতে হবে”। বিশেষ করে ২০১০ সালে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালুর পর, এই উদারতা আরও বিস্তার লাভ করে। ফলাফল হয়ে উঠেছিল শুধু পরিসংখ্যানের বিষয়—বস্তুনিষ্ঠতার নয়। শিক্ষার মান নিয়ে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশ্ন উঠলেও, সেই অবস্থার পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগই ছিল না। সেই জায়গা থেকে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর নীতিমালা এবং শিক্ষাবোর্ডগুলোর বাস্তব মূল্যায়নের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
এই বছর ১৩৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৫১টি। অর্থাৎ শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ৮৩টি। অন্যদিকে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান ছিল ৯৮৪টি। এসব পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মানের যে চরম বৈষম্য রয়েছে, সেটির বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে এবারের ফলাফলে।
বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গণিত ও ইংরেজি—এই দুটি বিষয়ে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল করেছে শিক্ষার্থীরা। সব বোর্ডে প্রায় ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করেছে এবং ১৩ শতাংশ ইংরেজিতে। বরিশাল বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৬৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আর গণিতে মাত্র ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। যেখানে অন্য বিষয়ের পাসের হার গড়ে ৯০ শতাংশের ওপরে, সেখানে এই দুই বিষয়ের এমন করুণ অবস্থা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে—এই বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি কতটা দুর্বল ছিল। শিক্ষক সংকট, মানসম্পন্ন পাঠদানের অভাব এবং পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ না থাকা, এগুলোর সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি।
এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে শীর্ষে রয়েছে রাজশাহী বোর্ড (৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ), এরপর যশোর বোর্ড (৭৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ) এবং কারিগরি বোর্ড (৭৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ)। অন্যদিকে সবচেয়ে খারাপ করেছে বরিশাল বোর্ড, যেখানে পাসের হার মাত্র ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এমনকি রাজধানীকেন্দ্রিক ঢাকা বোর্ডেও পাসের হার ৬৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। এই পার্থক্য বোঝায় যে, শিক্ষার মান দেশের অভ্যন্তরে কীভাবে বৈষম্যপূর্ণভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
একজন প্রধান পরীক্ষকের ভাষ্য অনুযায়ী, এবারে কোনো ধরনের গ্রেস মার্কস দেওয়া হয়নি। কেউ যদি ৭৯ নম্বর পায়, তবে সেটিকে বাড়িয়ে ৮০ করা হয়নি। খাতা মূল্যায়নে কোনো শিক্ষককে নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলা হয়নি। ভেন্যু কেন্দ্রগুলো পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, বাতিল করা হয়েছে কিছু কেন্দ্র। পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, খাতায় যা লিখেছে তার ভিত্তিতেই নম্বর দিতে হবে। এ বছর খাতায় ‘সহানুভূতির নম্বর’ প্রথা ছিল না বললেই চলে। এটিই প্রমাণ করে যে, দীর্ঘদিনের অন্ধ উদারতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করানোর সময় এখন।
শুধু খাতা মূল্যায়নের কড়াকড়ি নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতির অভাব এবং কোভিডকালে গড়ে ওঠা অলস পাঠাভ্যাসও এবারের খারাপ ফলাফলের অন্যতম কারণ। ২০২০ সালে পরীক্ষা ছাড়াই সবাইকে পাস করানো হয়। এরপরের বছরগুলোতেও নম্বর বাড়ানোর সংস্কৃতি অব্যাহত থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি ক্লাসে নিয়মিত পাঠদানের ওপর। তাই ২০২৫ সালের কঠোর মূল্যায়নের প্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে শিক্ষার্থীরা ভয়ানক বিপর্যয়ে পড়ে।
এই ফলাফলকে কেউ কেউ ‘ফল বিপর্যয়’ হিসেবে দেখলেও দেশের সচেতন মহল এটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অসংখ্য মন্তব্য পাওয়া গেছে যেখানে বলা হয়েছে—“এত জিপিএ-৫ দিয়ে কী হবে? বরং দরকার সঠিক মূল্যায়ন।” কেউ কেউ লিখেছেন—“এই ফলাফল শিক্ষার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে। এখন প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বাড়ানো।” দীর্ঘদিনের কৃত্রিম সফলতার মোড়কে ঢাকা থাকা শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানোই যে এখন সময়ের দাবি, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই আলোচনায়।
শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এক বিবৃতিতে বলেছেন, এবার ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে অতীতের মতো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জিপিএ-৫ বাড়িয়ে দেখানো হয়নি। কোনো ফটোসেশনের আয়োজনও হয়নি। বরং শিক্ষার্থীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়নের জন্য বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ফলে সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে পেরেছে শিক্ষাবোর্ডগুলো। তার মতে, এই ফলাফলের মাধ্যমে আমরা মেধার প্রকৃত মান যাচাই করেছি।
সাম্প্রতিক ফলাফলের নিরিখে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ি আরও বাড়াতে হবে। পরীক্ষকদের সহানুভূতির জায়গা রাতারাতি বদলানো সম্ভব নয়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বাস্তবমুখী হয়ে উঠবে। আগামী দিনে শিক্ষার্থীদের যদি এখনকার মতোই শ্রেণিপাঠে মনোযোগ কম থাকে, তবে ফলাফল আরও ভয়াবহ হতে পারে।
মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় ফেল করার হারও এবারের খারাপ ফলাফলের অন্যতম কারণ। মানবিকে পাসের হার মাত্র ৫৪ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ৬৬ শতাংশ। প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ফেল করেছে মানবিকে। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের ফলাফল ছিল নগর শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক দুর্বল। ফলে সার্বিক ফলাফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অতীতের রাজনৈতিক সরকারের আমলে এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৮০ শতাংশের ওপরে ছিল প্রায় প্রতি বছর। ২০১৪ ও ২০২১ সালে তো তা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। সেই তুলনায় এ বছরের ৬৮ শতাংশের ফলাফল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—অতীতে কীভাবে ফলাফলকে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং, এটিকে ‘ফল বিপর্যয়’ হিসেবে দেখা কতটা যৌক্তিক, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বরং বলা যায়, শিক্ষার মানোন্নয়নের এক দরজা খুলে দিয়েছে এবারের এসএসসি ও সমমানের ফলাফল। এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা—নকল, নম্বর বাড়ানোর সংস্কৃতি, অপ্রাসঙ্গিক লেখা আর রাজনীতিক অনুগ্রহ নয়; দরকার প্রকৃত মূল্যায়ন, মানসম্পন্ন পাঠদান, দক্ষ শিক্ষক, পাঠে মনোযোগী শিক্ষার্থী এবং জবাবদিহিতার শিক্ষা প্রশাসন। এই পথে হাঁটতে পারলেই শিক্ষার মানে আসবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। অন্যথায়, ফলাফল কেবলই থাকবে একটি সংখ্যা, শিক্ষার কোনো মান থাকবে না।
আলাউল হোসেন: কবি-গীতিকার, সাংবাদিক ও শিক্ষক; সর্বোপরি একজন নন্দনচেতন মানুষ। শিক্ষাব্রতী, প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠাতা, লিটলম্যাগ সম্পাদক, গবেষক ও সাংগঠনিক নেতৃত্বে নীরবে অথচ দৃপ্তপদে গড়ে তুলেছেন পাবনার সাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্যিক ভিত্তি। শুধু লেখেন না, মফস্বলের লেখকদের পথ দেখান; ছোটদের হাত ধরে নিয়ে যান সাহিত্যের দ্রুপদী উঠোনে। “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে” স্নাতকোত্তর। “আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট: গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিস ফর ইমপ্লিমেন্টেশন” বিষয়ে ডিপ্লােমা কোর্স সম্পন্ন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ভার্ড এক্স (অনলাইন প্রোগ্রাম) থেকে। পাবনার মাশুন্দিয়া-ভবানীপুর ডিগ্রি কলেজে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।