শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ: সেরা অভিভাবকীয় পন্থা

আলাউল হোসেন

শিশু মানেই সম্ভাবনার অপার দুয়ার। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক অনন্য প্রতিভা, যা সময় ও সুযোগ পেলে ফুটে ওঠে। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো একটি প্রচলিত ধারণা রয়ে গেছে- শুধুমাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডার হলেই যেন জীবনে সফল হওয়া যায়। এই সংকীর্ণ চিন্তার কারণে অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানের প্রকৃত মেধা ও সম্ভাবনাকে বুঝতে ব্যর্থ হন। তারা সন্তানের স্বপ্ন ও আগ্রহকে উপেক্ষা করে এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলাফল- অনেক শিশু একসময় হতাশায় ডুবে যায়, শিক্ষা ও জীবনের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অথচ, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হয়েও জীবনে সফল হওয়ার হাজারো পথ আছে, যা অভিভাবকদের উপলব্ধি করা জরুরি।

শিশুর মেধা ও এর বৈচিত্র্য:
প্রত্যেক মানুষের মেধা এক রকম নয়। কারও মেধা বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনায়, কারও শিল্প-সংস্কৃতিতে, কেউবা প্রযুক্তিতে পারদর্শী। এ ক্ষেত্রে শিশুর মেধাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়; যেমন:
১. একাডেমিক মেধা: যারা মূলত পড়াশোনায় পারদর্শী এবং বিজ্ঞান, গণিত, ভাষা ও সাহিত্য ভালো বোঝে।
২. সৃজনশীল মেধা: যারা গান, নাচ, ছবি আঁকা, সাহিত্য রচনা বা অভিনয়ে পারদর্শী।
৩. প্রযুক্তিগত মেধা: যারা কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং, ইলেকট্রনিক্স বা প্রযুক্তি-সম্পর্কিত কাজে আগ্রহী।
৪. খেলাধুলার মেধা: যারা শারীরিক কৌশল, দৌড়, ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার বা অন্যান্য ক্রীড়া ক্ষেত্রে দক্ষ।
৫. ব্যবসায়িক বা উদ্ভাবনী মেধা: যারা নতুন নতুন চিন্তা করতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে এবং উদ্যোগী হতে পারে।
৬. সামাজিক ও মানবিক মেধা: যারা মানুষের সাথে ভালোভাবে মিশতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে এবং সমাজের কল্যাণে কাজ করতে চায়।
এই ভিন্নতাগুলো বুঝতে না পারার কারণে অনেক শিশু নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় না। ফলে তারা জীবনে হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং প্রত্যাশিত সাফল্য লাভ করতে ব্যর্থ হয়।

অভিভাবকদের প্রচলিত ভুল ও তার প্রভাব:
আমাদের সমাজে অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন, যদি তাদের সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে না পারে, তবে সে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হবে। এই ধারণা থেকে তারা সন্তানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন, যা শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এ ধরনের মানসিক চাপের ফলে-
১. শিশুর আত্মবিশ্বাস কমে যায়।
২. পড়াশোনার প্রতি ভয় বা বিরক্তি জন্ম নেয়।
৩. সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়।
৪. হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করে।

অনেক শিশু ব্যর্থতার ভয়ে চরম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে, যা আমাদের সমাজে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

কীভাবে শিশুর ইউনিক মেধা খুঁজে বের করবেন?
সন্তানের মেধা আবিষ্কার করা এবং তা বিকাশে সহায়তা করা অভিভাবকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এর জন্য কিছু ধাপে কাজ করা যেতে পারে-
সন্তানের আগ্রহ পর্যবেক্ষণ করুন: কোন বিষয়ে সে আনন্দ পায়, কোন কাজ করতে গেলে সময়ের খেয়াল থাকে না—সেই বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখুন।
সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিন: ছবি আঁকা, গান গাওয়া, যন্ত্র বাজানো, অভিনয়, প্রোগ্রামিং, গল্প লেখা ইত্যাদির প্রতি সন্তানের আগ্রহ থাকলে তাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ দিন।
স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখান: শিশুর ওপর নিজের পছন্দ চাপিয়ে না দিয়ে তাকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিন।
প্রশংসা করুন ও আত্মবিশ্বাস বাড়ান: প্রতিটি ছোট ছোট অর্জনকেও গুরুত্ব দিন এবং তাকে উৎসাহিত করুন।
সঠিক দিকনির্দেশনা দিন: যদি সে খেলাধুলায় ভালো হয়, তাহলে ভালো প্রশিক্ষক খুঁজে দিন। যদি সে প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিন।

সফলতার সংজ্ঞা নতুনভাবে নির্ধারণ করা জরুরি:
সফলতা মানে শুধু বড় চাকরি বা অর্থবিত্ত নয়, বরং সফলতা মানে আত্মতৃপ্তি, আনন্দ ও নিজের প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ। আজকের বিশ্বে এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে দক্ষতা অর্জন করে কেউ একজন প্রচুর সম্মান, অর্থ ও স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে—
১. একজন শিল্পী বা ডিজাইনার আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করতে পারেন।
২. একজন ভালো উদ্যোক্তা হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।
৩. একজন ক্রীড়াবিদ দেশকে গৌরব এনে দিতে পারেন।
৪. একজন প্রযুক্তিবিদ বা প্রোগ্রামার বৈশ্বিকভাবে নিজের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন।
৫. একজন ইউটিউবার বা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর কোটি কোটি মানুষের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন।

তাই অভিভাবকদের উচিত, সন্তানদের প্রতিভা অনুযায়ী তাদের পথ তৈরি করে দেওয়া, যাতে তারা তাদের পছন্দের ক্ষেত্রে সফল হতে পারে।

অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে- প্রতিটি শিশুই এক একটি সম্ভাবনার বীজ। এই বীজকে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে তা একদিন মহীরুহে পরিণত হবে। অভিভাবকদের উচিত নিজেদের সংকীর্ণ চিন্তার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে সন্তানের আগ্রহ ও প্রতিভাকে মূল্যায়ন করা। কারণ, যে শিশু তার ভালোবাসার কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করতে পারে, সে-ই প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারে।
তাই আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদের তাদের স্বপ্নের পথে হাঁটতে দিই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও পৃথিবীতে সফল হওয়ার অগণিত সুযোগ আছে— শুধু দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা ও সমর্থন। একদিন এ শিশুরাই হবে আগামী দিনের আলোকবর্তিকা, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হয়ে পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে তুলবে।

আপনি এই সাইটের কন্টেন্ট কপি করতে পারবেন না